ওকে আমি যখন প্রথম দেখি তখন রাত প্রায় ১২টা ছুঁইছুঁই করছে। বিজয় সরনীর রাস্তার মোড়ে একা দাঁড়িয়ে ছিলো ।ল্যাম্পপোষ্টের হলুদ আলোয় খুব বেশি সাধারন মেয়েই মনে হচ্ছিলো সবকিছুতেই গ্রাম্যতার ছাপ স্পষ্ট। চোখ ফিরিয়ে নিতে নিতেও আটকে গেলো। ছোট্ট নাকটিতে বসে থাকা বিশাল নাকফুলটি কিংবা দুচোখের নিচে লেপ্টে যাওয়া কাজল সবকিছু বদলে দিলো। মনের ভ্রম নাকি হলুদ আলোর মোহ আমি জানিনা কারন একটু পরেই আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় ঢাকা এই শহরের পিচঢালা রাস্তায় আমি হাঁটছি, সাথে আছে এক হলুদ পরী। আকাশ থেকে মাটিতে নেমে পথ হারিয়েছে কিছু বলতে পারছে না যাই জিজ্ঞেস করি সে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। কান্না থামাতেও বলতে পারছি না
তাহলে যে আমার ক্ষুদ্র জীবনের সুন্দরতম কিছু দৃশ্যপট হারিয়ে যাবে। অনেক সাধনার শেষে উন্মোচিত হলো হলুদ পরীর ভূপতিত হবার কারন। বরিশালের প্রত্যন্ত গ্রাম মৌয়ালচর থেকে তিনি ঢাকা ল্যান্ডিং করেছেন আজ রাতে কিন্তু বাস থেকে নামতে গিয়ে অতীব দুর্ভাগ্যবশত ( কিংবা আমার সৌভাগ্যবশত) বাবাকে হারিয়ে ফেলেছেন বাবা কিংবা মেয়ে কারো কাছেই নাকি আবার মোবাইল টোবাইল কিছুই নাই। যোগাযোগের কোনো রাস্তা বাতলাতে পারলাম না। জানলাম তার নাম "কলি" আর কাল নাকি তার আবার ঢাকা মেডিকেলে ওয়ারিন্টেশন ক্লাশ, কিছুটা টাশকিত হইলাম, সারাজীবন ঢাকায় এতো সুযোগ সুবিধায় পড়াশোনা করলাম ঠিকই কিন্তু মেডিকেলীয় ভর্তিযুদ্ধে পেলাম লাড্ডাগাড্ডা ;বাপের লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রাইভেটে পড়ছি আর উনি কোথা থেকে উড়ে এসে আমাদের এখানে জুড়ে বসলেন। এত রাতে কই যাবো ,কি করবো ভাবছি. . . . . . . . . . ঠাস করে তিনি বলে বসলেন,
"আপনার বাসায় আজ রাতে আমায় থাকতে দিবেন?"
দ্বিতীয়বার টাশকিত হইলাম। চেনা নাই, জানা নাই কোনো ছেলের কাছে কোনো মেয়ে যে এমন আবদার করতে পারে তা কোনভাবেই আমার ক্ষুদ্রমস্তিষ্কে বোঘ্যগম্য হইলো না ; বুঝতে পারলাম এই যান্ত্রিক জীবনের মারপ্যাচ সে জানে না, মনটা ঠিক বৃষ্টিধোয়া নীল আকাশের মত সতেজ সুন্দর আর সরল। পরবর্তী কাহিনী অতি সংক্ষিপ্ত। আম্মু কে ম্যানেজ করা, আমাদের বাসায় তাকে রাখা এবং পরদিন মেডিকেল কলেজে গিয়ে তার বাবাকে উদ্ধার করা, চাচার হাত ধরে কথা দেয়া তার মেয়ের খেয়াল রাখার দায়িত্ব নেয়া সবকিছুই অতি উত্সাহের সাথে সুনিপনভাবে আমি সম্পন্ন করলাম ।
সময় ঘড়ি চলতে থাকে নিজস্ব নিয়মে আর কলির প্রতি আমার দুর্বলতা বাড়তে থাকে । কিন্তু কখনো বুঝাতে পারিনি মিস আতেল বেগম কে । হয়তো তাকে বলেছি "জানো, তুমি পাশে না থাকলে আমার বুকের ভিতরটা যেন কেমন কেমন করে" আর সে কিনা আমায় মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশনের কারন বলা শুরু করে!!! কোন এক ভ্যালাইন্টানে হাত ভর্তি লালগোলাপ নিয়ে সামনে গিয়েছি বলতে চেয়েছি "কলি, আমি তোমায় ভালোবাসি" কিন্তু তার সামনে যেয়ে তোতলামি আর অতিরিক্ত নার্ভাসের ফলস্বরূপ যখন ঘামতে শুরু করলাম তখন সে আমার হাইপ্রেশার হয়েছে বলে এক গাদা বকবক শুরু করলো আর আমি???
শুধু অপলক চেয়ে দেখলাম তার কাজলটানা চোখ আর আমার হাতভর্তি ফুলের চেয়ে বহুগুনে সুন্দর ওই ছোট্ট নাকে বসানো বড়সড় নাকফুলটি।
বোকাসোকা মেয়েটি কখনো বুঝতে পারে নি, কেনো বেনামি পার্সেলে চলে আসে তার প্রয়োজনীয় বই, সে কথনো চিন্তা করে ও দেখেনি যখন হোষ্টেল কিংবা কলেজগেটে তার বান্ধুবীরা রিকশার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনে তখন রিকশাওয়ালা মামা কেনো এগিয়ে আসে তার কাছে, কলি কখনো জানতে ও পারে নি আশেপাশের দোকানগুলোতে ওর প্রিয় আইসক্রীম কিনতে গেলে কেনো কখনো দোকানদার ওর কাছ থেকে টাকা নিতো চায়নি। এতটা বেশিই অবুঝ ছিলো সে. . . . . . . . . . . . . . . .কিংবা আমি সৌরভ নিজেই কখনো বুঝতে পারি নি তাকে। মনে মনে ভাবছিলাম আর একটা বছর পরই তো আমাদের এম.বি.বি.এস. টা কমপ্লিট হলে আমি সরাসরি ওর বাবাকে গিয়ে বলব "চাচা, আমি ওর সারাজীবন খেয়াল রাখতে চাই হারিয়ে পাওয়া আপনার মেয়েকে আমি খুঁজে রাথতে চাই আমার ছোট্ট ঘরে"
কিন্তু বিধাতার চাওয়া ছিলো ভিন্ন।তাইতো ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় যাকে খুঁছে পেয়েছিলাম তাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম ঝলমলে লাল নীল সবুজ হাজার আলোকবাতির ভীড়ে, প্রথম তাকে পেয়েছিলাম একা আর শেষবারের মতো তাকে হারিয়ে যেতে দেখলাম শত মানুষের মাঝে সাথে ছিল বিশিষ্ট কার্ডিয়াক সার্জন মাহমুদুল হাসান, আমি কোথাকার কোন আন্ডার এম.বি.বি.এস তার সামনে গিয়ে বলব আমাকে বিয়ে করার কথা বলব. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .অতি সাধরন বেশে যাকে প্রথম দেখেছি শেষবার তাকে দেখলাম আভিজাত্যের পূর্ণ ছোয়াঁয়। চোখে তার দক্ষ বিউটিশিয়ানের হাতের সাজ, নাকের উপর দখল করেছে হীরা ঝলমলে ছোট্ট নাকফুল। সে কাদঁছিলো কিন্তু এবার কেনো লেপ্টে যায় নি তার কাজল, তবুও কেনো আমি অপলক চেয়ে থাকতে পারি নি, কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠছিলো সব. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . যেমনি ভাবে আমার জীবনে এসেছিলো হলুদ পরী হয়ে তেমনি ভাবে উড়ে চলে গেলো লালপরী সেজে.
by- টিনটিন টিউলিপ
Osadharon
ReplyDelete