Wednesday, December 4, 2013

‘অপেক্ষার প্রহর শেষে’ (তৃতীয় পর্ব)

হঠাত্‍ করেই হাসিখুশি আনুভার মনটা বিষাদের কালো ছায়ায় ঢেকে গেল। সারাটা দিন চুপিচুপি দরজা বন্ধ করে একা বসে কেঁদেছে, সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তার কিছুই ভালো লাগছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সব মিথ্যা, রুপমের মতো হাবাগোবা ছেলে কখনও এরকম হতে পারে না। আবার ভাবে, হাবাগোবা চেহারার মুখোশের আড়ালে হয়ত আসল কালো চেহারাটা লুকিয়ে আছে তাই এমন কাজ করেছে। আনুভা কিছু ভাবতে পারছে না, তার মাথায় কিছুই কাজ করছে না, যতই ভাবছে ততই কান্না পাচ্ছে। হঠাত্‍ করে তার মাথায় আসল, আচ্ছা আমি কাঁদছি কেন? এ প্রশ্নের সঠিক কোন উত্তর পেল না। রূপম তার কে হয়? রূপমের জন্যে সে কাঁদবে কেন? রূপম যা ইচ্ছা করুক তার কি আসে যায়! তবুও সে নিজেকে সান্তনা দিতে পারল না, হু হু করে কাঁদতে লাগল। তার বুকে কোন কিছু হারিয়ে ফেলার তীব্র বেদনা আঘাত করছে, এ যেন প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার মতো বেদনা।



রূপম পুরোপুরি বিপর্যস্ত, হঠাত্‍ করেই তার চেনা পৃথিবী অচেনা হয়ে গেছে। ক'দিন আগেই সে ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, আর বর্তমানে সে একেবারে ভূপাতিত। তার সবসময়ের শখ ছিল প্রকৃতির ছবি তোলা, তাছাড়া মানুষের জীবনযাত্রা আর স্ট্রীট ক্যানডিড শটগুলো সে নিত। সামান্য কিছু পয়সা বেশি পাবার জন্যে কয়েকজনের পরামর্শে শুরু করল মডেল ফটোগ্রাফি আর এটাই তার কাল হলো। অথচ মাঝে মাঝে বিয়েতে ছবি তোলার জন্যে যথেষ্ট টাকাই পেত, 'অতি লোভে তাঁতী নষ্ট' অবস্থা হয়ে গেছে। আসলে সে চেয়েছিল কিছু বাড়তি পয়সা যোগাড় করে জমাতে, বিয়ে করে ফেলার চিন্তাভাবনা। সব কিছু নষ্ট হয়ে গেল নিমিষেই, তার সব রাগ এখন গিয়ে পড়ছে তার মডেল অহনার উপর।

সোফার সামনের ছোট্ট টেবিলের উপর থেকে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিতে গিয়ে আবার চোখে পড়ল পত্রিকাটি। পত্রিকার বিনোদন ও সংস্কৃতি পাতায় বড় বড় লাল কালিতে লেখা, ''ফটোগ্রাফার রূপমের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করলেন মডেল অহনা''

অহনা আর রূপমের অন্তরঙ্গ ছবিসহ পত্রিকাতে বিস্তারিত লেখা আছে,
ইন্ডিয়ান জার্নাল থেকে পুরষ্কার প্রাপ্ত বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রূপমের বিরুদ্ধে গতকাল রাতে মোঃপুর থানায় ধর্ষণের মামলা করেছেন উঠতি মডেল অহনা।
বিস্তারিত সংবাদে জানা যায়, দীর্ঘদিন অহনার সাথে কাজ করে আসছিলেন রূপম। তারা ফটোশ্যূটের জন্যে কক্সবাজারে তিন দিন ছিলেন গত মাসে। অহনার দাবি অনুযায়ী, রূপম কক্সবাজারে গিয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, অহনা নিমরাজি ছিলেন ব্যাপারটায়। পরে রাতে বিয়ের করার আশ্বাস দিয়ে একই রুমে দুজনে রাত কাটান। বর্তমানে অহনা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে রূপম এর পিতৃত্ব অস্বীকার করেন। পরে পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে অহনা কাল রাতে মোঃপুর থানায় ধর্ষণের মামলা করেন।
সকাল থেকেই অহনার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ রূপম, অহনা একেবারে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। রূপম রাগে দুঃখে মুঠোফোন, মুখবই সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিল।

কয়েকমাস কেটে গেল এরই মাঝে, আনুভা এখনও নিজেকে গুছিয়ে তুলতে পারে নি, সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে। এরই মধ্যে তার স্নাতক পরীক্ষার ফলাফল বের হয়ে গেছে। রূপমের সাথে কাটানো দুদিন এখনও ভুলতে পারছে না, জীবন এর আগে কাউকে তেমন একটা ভালো লাগে নি। ভালবাসাবাসির ব্যাপারটা থেকে সবসময় গুটিয়ে রেখেছে নিজেকে, বান্ধবীরা প্রেম করেছে, সে পাশ থেকে শুধু দেখেই গিয়েছে। রক্ষনশীল পরিবার ব্যবস্থার দরুন কখনও সাহস হয় নি কারো সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। হুট করেই ভাল লেগে গিয়েছিল সেদিন রূপমকে, একটা গম্ভীর ভাবসম্পন্ন হাবাগোবা ছেলে, চোখের তারায় একটা নেশা নেশা ভাব আছে আর সে সেই নেশায় জড়িয়ে গিয়েছিল। অবশ্য সে বুঝতে পেরেছিল রূপমও তার প্রতি কিছুটা দূর্বল। প্রথমে মনে করেছিল ব্যাপারটা রূপমের প্রতি তার ভালোলাগা, মোহ কিন্তু এতটা মাস মোহ কাজ করে না, মোহ ছমাসের মধ্যেই কেটে যায়।

একটা সময় পর আবিষ্কার করল সে রূপমের প্রেমে পড়েছে এবং এ ব্যাপারটা ঘটেছে রূপমের নামে পত্রিকায় সংবাদ দেখার পর থেকেই। যখন থেকে অনুভব করতে লাগল সে রূপমকে ভালবাসে ঠিক সে মূহুর্ত থেকে তাকে প্রচন্ড ঘৃণা করতে লাগল। সেলিব্রেটিরা এরকমই হয়, মেয়ে ফাঁসানোর তাদের কাজ. সস্তা জনপ্রিয়তা তাদের মাথা নষ্ট করে দেয়। আনুভা তাকে ভুলতে চেষ্টা করে কিন্তু ভুলতে চাইলেই কি ভুলা যায়? বারবার মনে ঘুরে ফিরে আসে সেই দুদিনের প্রতিটা মূহুর্ত, তীব্র ঘৃণা কাজ করে তার মনে এর পর মূহুর্তেই। ভালবাসার ওপিঠেই ঘৃণার বসবাস, যাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসা হয় তাকেই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করা যায়, আনুভা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

অবশ্য এরই মধ্যে আনুভা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে রূপমের সাথে যোগাযোগ করতে মুঠোফোন আর মুখবইতে কিন্তু পারে নি। মুঠোফোনের নম্বর অনেক কষ্টে যোগাড় করতে পারলেও সেদিনের পর থেকে রূপমের মুঠোফোন একেবারে বন্ধ এবং তার মুখবইয়ের আইডি অচল। সে চাইছিল একবার শুধু রূপমকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে, সত্যিই সে দোষী কিনা, দূর্ভাগ্যবশত সে চেষ্টাও তার বৃথা গেল।
এই কয়েকমাসের মধ্যে রূপমের জীবনে বিশাল পরিবর্তন চলে আসলো, ঢাকা শহরের বাসিন্দা রূপম হঠাত্‍ করে হয়ে গেলো গ্রামীন মেঠো পথের পথিক। গ্রামের পথে এদিক ওদিক হেঁটে বেড়ায়, হাতে থাকে নিকনের ৭০-১৩০এমএম লেন্সের ক্যামেরা, গ্রামীন পরিবেশের ল্যান্ডস্কেপ ছবি তুলতে থাকে একে একে। গ্রামের আসার আগে তাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে, অহনার করা মামলার কারনে দুদিন পর পুলিশ এসে তাকে থানা হাজতে ধরে নিয়ে যায়। তিনদিন থানা হাজতে থাকার পর বহু ঝামেলা পেরিয়ে জামিন পায়।

জামিন পাওয়ার পর বাসায় আসলেও তার মন চাইছিল না ঢাকায় থাকতে কারন ঢাকার পরিচিত সবার সামনে সে অপদস্ত হয়ে গিয়েছিল মামলার কারনে। তাছাড়া ফটোগ্রাফি সোসাইটি, মুখবইয়ের সর্বত্র অহনা ও তাকে নিয়ে রসালো আলোচনা হচ্ছিল। তার কাছে পুরো পৃথিবীটাই অসহ্য আর বিরক্তিকর মনে হচ্ছিলো। মুঠোফোন, মুখবই সবকিছুর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সে চলে যায় একেবারে গ্রামে, তার দাদার বাড়িতে। দাদার বাড়িতে তেমন কেউ থাকে না, একজন দূর সম্পর্কের চাচা তার পরিবার নিয়ে সেখানে থাকেন। রূপম তাদের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে নতুন নাম লেখালো। ভালোই কাটছিল গাঁয়ের দিনগুলি তার, পরিচিত জীবনযাপনে একঘেয়েমি চলে আসার পর গ্রামকে তার অনেক আপন মনে হয়, গ্রামের সবকিছুই তার ভালো লাগে।

প্রথমদিকে কয়েকদিন ক্যামেরা ছুঁয়েও দেখে নি, যে ক্যামেরার কারনে আজ তার এই অবস্থা সে ক্যামেরা না ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা পোষণ করল। পরে ভেবে দেখলো, তার শিকড়ে ফিরে যাওয়া উচিত যদি আবার জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে চায়। মডেল ফটোগ্রাফির পোট্রেইট ছবি তোলার ৫০এমএম লেন্স বাদ দিয়ে ৭০এমএম এর লেন্সে কাজে নেম পড়ল প্রকৃতির ছবি তোলার জন্যে।

হঠাত্‍ একদিন বিকেল বেলা, বাজারে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলো, তখন আচমকা চোখ পড়ল একটা মেয়ের দিকে। মেয়েটা টিস্যু দিয়ে মুছে তা ফেলে চলে যাচ্ছিল। তা দেখে তার মনে পড়ল আনুভার কথা, এবং সাথে সাথে মনে অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল। আনুভা নামের সেই মেয়েটি কোথায় আছে? কেমন আছে? একবারও তার খবর নেয় নি। তার এইসব ঘটনা জানে কিনা? সে কি রূপমকে ভালবাসে? এরপরও ভালবাসবে? এতগুলো প্রশ্ন তার মনে কিন্তু একটারও উত্তর তার কাছে নেই। একই সাথে তার বুকে খামছি মেরে বসল এক দলা বেদনা, প্রথম দেখায় ভালোলাগার সেই মেয়েটির জন্যে আবার প্রেম জাগতে লাগলো মনে কিন্তু নিজেকে আরও ছোট মনে হতে লাগল তার।

লিখেছেন: Akib Ariyan

No comments:

Post a Comment