Wednesday, December 4, 2013

‘অপেক্ষার প্রহর শেষে’ (পঞ্চম এবং শেষপর্ব)

গাছের উপর যখন ঝড়ের আঘাত আসে তখন তার ডালপালা উঁড়িয়ে নিয়ে যায়। একটা সময়ের পর আস্তে আস্তে গাছে নতুন পাতা গজায়। গাছের ডাল-পালা বিস্তৃত হয়। কিন্তু ঝড়ের আঘাত যখন গাছটাকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে, তখন গাছের মৃত্যু হয়।

রুপমের জীবনে একটার পর একটা ঝড় এসেছে। শেষ ঝড়টা যেন তাকে কুপোকাত করে দিয়ে গেছে। বেঁচে আছে এখনো কিন্তু একে ঠিক বেঁচে থাকা বলেনা। স্বপ্নের মৃত্যু মানে আত্নার মৃত্যু। আত্নার মৃত্যু হলে উপরে খোলসটা রয়ে যায় কিন্তু ভেতরটা কেমন যেন নির্জীব হয়ে পড়ে। কোন ব্যাপারে উৎসাহ কাজ করেনা। সুন্দর গুছানো জীবনটা চোখের পলকে একটু একটু করে ক্ষয়ে যায়। একে ঠিক মৃত্যু বলেনা। তবে এটি মৃত্যুরই আরেকটি রুপ।



রুপম নিজেই নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এভাবে কতদিন পালিয়ে বেড়াতে পারবে সে জানেনা। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জীবনে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। সকাল ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর প্রিয় মানুষটার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালে, আরো অনেকদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে।

কিংবা সারাদিন হাঁড় ভাঙ্গা খাটুনির পর ঘরে ফিরে এসে প্রিয় মানুষটার হাসি হাসি মুখের দিকে তাকালে সমস্ত ক্লান্তি এক নিমেষে দূর হয়ে, বড্ড বেরসিক জীবনটার প্রতিও মায়া পড়ে যাবে। অস্ফুটস্বরে মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবে, জীবনটা আসলেই সুখের। তবে সুখটাকে খুঁজে নিতে হয়। মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকে। জীবনের সব আশা, চাওয়া-পাওয়া যখন বিলীন হয়ে যায় তখন বেঁচে থাকাটা যন্ত্রনায় রুপ নেয়। শরীর এবং মন জুড়ে ক্লান্তি নেমে আসে। দম বন্ধ হয়ে আসা এক ধরনের অনুভূতির জন্ম দেয়। এতদিনের চেনা-জানা জগতটাকে বড্ড বেশি অচেনা মনে হয়।

একজন মানুষ কতটা অসহায় হতে পারে তা রুপমকে না দেখলে বোঝা যায়না। রুপম নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। নিজের জন্য আলাদা একটা জগত তৈরি করেছে। নিজের অসহায়ত্ব, একাকিত্বকে কাটিয়ে উঠতে নিজেকে সমর্পন করেছে নেশার কাছে। সারাদিন নেশায় বুদ হয়ে থাকে। দিন রাতের ফারাক নেই। সময় কিভাবে বয়ে যাচ্ছে তার কোন হিসাব নেই।

মাঝরাতে যখন ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখে। হঠাৎ একটি তারা পথ ভুলে ছুটে যায়। বড্ড অভিমানী সে তারা। দেখা দিতে চায়না। দূরে গিয়ে হারিয়ে যায়। সেই অভিমানী তারাটার সাথে আনুভার বড্ড বেশি মিল খুঁজে পায় রুপম। রুপম চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। কিন্তু আনুভাকে সে কিছুতেই বোঝাতে পারেনি সে নির্দোষ। তার ভালোবাসা বারবার পরাজিত হয়ে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। শেষপর্যন্ত ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়ে সে ফিরে এসেছে। কড়া নাড়েনি দরজায়।

আর থাকতে না পেরে গভীররাতে রুপম চুপিচুপি আনুভার বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে থাকে জানালার দিকে। যদি দূর থেকে একবারের জন্য আনুভাকে দেখতে পায় সেই আশায়। অনুভা তার জীবনে নেই, এই ভাবনাটা মনে আসতেই ধ্বক করে উঠে বুক। সোডিয়াম বাতির রহস্যময় আলোয় ক্লান্ত শরীরে ধীর পায়ে রুপম হেঁটে যায়। ফিরে যায় একবুক হতাশাকে সঙ্গী করে।

আনুভা রুপমকে ভুল বুঝেছে। কত অনুনয় বিনয় করার পরও বার বার অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছে। শেষবার যখন দেখা হয়েছিল প্রচন্ড খারাপ ব্যবহার করেছিল আনুভা। রুপম তার প্রতিউত্তরে কিছুই বলেনি। বিভ্রান্তের মত তাকিয়ে ছিল শুধু ওর দিকে। হয়ত বিশ্বাস করতে পারছিল না, আনুভা ওকে এভাবে অপমান করবে।

আজ নিজেকে বড্ড বেশি দোষী মনে হয় তার। সে চাইলেই রুপমকে একটা সুযোগ দিতে পারত। কিন্তু কেন দেয়নি এটা ভাবতেই তার কান্না পাচ্ছে। রুপমকে যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে। খুঁজে বের করে ওর ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে। আর কখনো ওর জীবন থেকে হারিয়ে যেতে দিবেনা। কোনদিন না। এতদিনে সে বুঝে গেছে রুপমকে ছাড়া তার জীবন অসমপূর্ন। জীবনটাকে পরিপূর্ন করতে রুপমকে তার চাই-ই চাই।

সময় অসময়ে আনুভা জানার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর চঞ্চল চোখ কি যেন খুঁজে বেড়ায় প্রতিটিক্ষন। পরিচিত রাস্তা-ঘাট, ল্যাম্পপোষ্ট সবকিছু আগের মতই আছে। শুধু রুপম নেই দাঁড়িয়ে ওখানে। এক অজানা আশঙ্কায় আনুভার বুক কেঁপে ওঠে। রুপম যদি আর কোনদিন ফিরে না আসে, একঘেয়েমী জীবনটা একা কি করে ও বয়ে বেড়াবে? ভীষন কষ্ট হবে রুপম যদি ওর পাশে না থাকে।

রুপমকে খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করেছে আনুভা। সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজেছে। কিন্তু কেউ ওর কোন খোঁজ দিতে পারছেনা। একজন জলজ্যান্ত মানুষ এইভাবে হাওয়া হয়ে যাবে আনুভা মেনে নিতে পারছেনা। অনেক খুঁজে একটা বাসার ঠিকানা জোগাড় করেছিল। ঠিকানা পাবার পরপরই আনুভা ছুঁটে গেল রুপমের খোঁজে। কিন্তু সেখানে গিয়েও হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে ওকে। ভীষন মুষড়ে পড়েছে রুপমকে সেখানে না পেয়ে।

বিকেলের দিকে রুপম শাহবাগ যাদুঘরের সামনে একা বসে আছে। গায়ে একটা মলিন পাঞ্জাবী। চুল উস্কোখুস্কো, কতদিন হল দাঁড়ি গোঁফ কামায়নি দেখে বোঝার কোন উপায় নেই। ওকে দেখে কেমন যেন উদভ্রান্ত মনে হচ্ছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, কিন্তু সিগারেট টানছেনা। হয়ত ভুলেই গেছে কখন সিগারেট জ্বালিয়েছে। সিগারেট টা একটু একটু করে পুঁড়ে ছাঁই হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে কি যেন বিড় বিড় করে যাচ্ছে।

মুনিয়া একটা জরুরী কাজে টিএসসি এসেছিল। বাসায় ফেরার পথে জাদুঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ চোখ গেল রাস্তার পাশে বসে থাকা একটা ছেলের দিকে। ছেলেটাকে কেমন যেন পরিচিত লাগছিল। মুনিয়া তবুও হাঁটার গতি কমায়নি। ছেলেটাকে পাশ কাটিয়ে কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ মনে এলো, ‘এটা রুপম নয়তো?’ মুনিয়া পেছন ঘুরে গভীর মনযোগে ছেলেটার দিকে তাকাতেই চমকে উঠল। এ কি হাল হয়েছে ছেলেটার? তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে মুঠোফোন বের করে আনুভাকে ফোন করে। তারপর সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে আনুভার আসার।

মুনিয়ার ফোন পেয়ে আনুভা ঝড়ের বেগে বাসা থেকে বের হয়ে আসে। ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলবে, সেই ভাবনাও মাথায় আসেনি। গেটের সামনে একটা রিক্সা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তড়িঘড়ি করে তাতেই চেপে বসল। উত্তেজনায় আনুভার শরীর কাঁপছে। আজ কতদিন পর রুপমের সে দেখবে। রুপম যদি তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে? কিংবা প্রতিশোধ নেবার জন্য তাকে ফিরিয়ে দেয়? নাহ! রুপম কিছুতেই তার সাথে এমন করবে না।

এমন ভাবতে ভাবতেই রিক্সা কাঁটাবনের কাছাকাছি চলে এলো। আর ঠিক তখনি কে বা কারা যেন দ্রুতগামী একটা বাসকে লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে দিল। বোমাটি লক্ষ্যচ্যুত হয়ে আনুভার রিক্সায় উপর এসে পড়ল। পড়তেই ওর সিল্কের জামায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের তাপে আনুভা গগনবিদারী চিৎকার শুরু করল।

রাস্তার আশেপাশের লোকজন ছুটে আসল সাহায্যের জন্য। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ধরাধরি করে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হল। সাহায্যকারীদের মধ্যে একজন আনুভার পুঁড়ে যাওয়া ব্যাগ ঘেঁটে অক্ষত অবস্থায় মুঠোফোনটা বের করে আনে। ডায়াল লিস্টের প্রথমে মুনিয়ার নাম্বার পেতেই তাকে ফোন করে বিস্তারিত সব ঘটনা জানায়।

মুনিয়া দৌড়ে গিয়ে রুপমকে সবকিছু জানাতেই, রুপম অবিশ্বাসের চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো মুনিয়ার দিকে। তারপর মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে রাস্তায় বসে পড়ল। কয়েক সেকেন্ড লাগল ধাতস্থ হতে। তারপর দুইজনেই তড়িঘড়ি করে ছুটল ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে। রুপম শক্ত হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে মানুষের ভীঁড়, চিৎকার চেঁচামেচি। কত মানুষের কান্না কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করছেনা। আনুভা তার সাথে দেখা করতে আসার সময় এই ঘটনা ঘটেছে।

আজকে আনুভার এই অবস্থার জন্য তার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। অবশ্যই সে অপরাধী। সে যদি তখন হাল ছেড়ে না দিয়ে চেষ্টা করে যেত, তবে আজ আনুভার এই অবস্থা হত না। নিজের উপর তার প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছে। সে যদি বেঁচে না থেকে মরে যেত তাহলে বরং ভালো হত। অন্তত আনুভাকে পোঁড়া শরীরে এভাবে ছটফট করতে দেখতে হত না।

পেট্রোল বোমায় আনুভার শরীরের চল্লিশ শতাংশ আগুনে পুঁড়ে গেছে। মুখের একপাশে সামান্য কিছু অংশ জুড়ে আগুনের তাপে ঝলসে যায়। প্লাস্টিক সার্জারী ছাড়া তা রিকভার করার কোন সম্ভব নয়। ডাক্তার আনুভার শরীরে ব্যান্ডেজ করে আপাতত ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। মুনিয়ার ফোন পেয়ে আনুভার বাসা থেকে লোকজন ছুটে এসেছে। তারা এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে। আনুভার মা আঁচলে মুখ ঢাকা দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আনুভার বাবা উনাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।

রুপম হাসপাতাল ছেড়ে এক মিনিটের জন্যেও কোথাও যায়নি। একবারের জন্যেও ঘুমে ঢলে পড়েনি। সারারাত আনুভার ওয়ার্ডের পাশে ঘুরঘুর করেছে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে আনুভার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়ে এসেছে। পরদিন আনুভার যখন জ্ঞান ফিরে আসল তখন রুপম ছুটে গেল আনুভার পাশে। বেডের পাশে একটা টুল দেখে বসে পড়ল। আনুভার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠল। আনুভা শূন্য দৃষ্টিতে রুপমের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু তার সবই অস্পষ্ট।

আনুভা রুপমের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসতে পারল না। মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে, ভীষন যন্ত্রনা হচ্ছে ওর। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেনা। চোখ চিক চিক করছে। একসময় চোখের কোন বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। রুপম ওর গাল স্পর্শ করে অশ্রু মুছে দিল। রুপম কি করবে, কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। আনুভা-ই শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে মুখ খুলল, ‘রুপম আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি; বিশ্বাস করো।’

অনুভার হাতের মুঠো চেপে ধরে রুপম বলে উঠে, ‘তুমি ফিরিয়ে দেবার পর, এতগুলো দিন নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছি আমি। কিন্তু একটিবারের জন্য ও এই মন থেকে হারাতে দেইনি তোমাকে।’ সব ঠিক হয়ে...কথা শেষ করতে পারেনা রুপম। মাঝপথে ওকে থামিয়ে দেয় অনুভা। কিন্তু আমার শরীর পুঁড়ে গেছে। ঝলসে গেছে মুখ। আমাকে দেখতে এখন কুৎসিত লাগবে। আমাকে দিকে তাকাতে তোমার খারাপ লাগবে। তুমি যদি আমাকে আগের মত ভালোবাসতে না পারো?

রুপম একটা আঙ্গুল দিয়ে আনুভার ঠোঁট চাপা দিল। অন্যহাতে আনুভার হাতের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরল, চুপ! আর কোন কথা নেই। ‘আমি যদি তোমাকে ভালোবাসতে না পারি তবে আর কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারবেনা। কেউনা।’ তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। জীবনের প্রতিটা মুহুর্তে ঠিক এভাবে হাত ধরে পাশাপাশি চলব দু’জন।

“গভীর নীরবতা নেমে এসেছে চারপাশে। কারো মুখে কোন কথা নেই। দু’জনের গাল বেয়ে সুখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। পথ হারানো দুটি পাখি যেন নীঁড়ের দেখা পেয়েছে। তৃষ্ণার্ত দুটি প্রানের বহুল প্রতিক্ষীত অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে”

---------------- ---------------------- ---------------------- -------------------


লিখেছেনঃ Hasan Mahmud Tushar 

No comments:

Post a Comment