Wednesday, December 4, 2013

‘অপেক্ষার প্রহর শেষে’ (চতুর্থ পর্ব)

কালো দীর্ঘ দেয়ালে যখন সূর্‍্যের আলো পরে হঠাৎ করে তাকে দেখে কালো না মনে হলেও সে কালোই থাকে। সীমানার বাহিরের মানুষ গুলো হয়তো তাদের দুরবর্তী চোখ দিয়ে কাউকে দেখে সুখী ভাবে, অথবা ভাবে সুখ ওই রকম। কিন্তু প্রতিটা অস্তিত্ব একিরকম টানাপোড়নে থাকে। আর সুখ! সে সবার হাতের মুঠোয় আলোর মত লুকোচুরি খেলে। মুঠো খুলে রাখতে হবে যাতে তাতে আলো টুকু পড়ে, বন্ধ করলেই হারিয়ে যাবে। ধরা যাবে না!



অন্ধকার বারান্দায় বসে ছিল আনুভা, হাতের কফির মগে কফি বহু আগেই ঠান্ডা হয়ে গেছে, তবু ধরে থাকা। রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের হলুদ আলো, আর ওই নাম না জানা গাছের পাতাগুলোর আলোছায়া। রাত গভীর হয়েছে, অথচ হঠাৎ করেই যেন নির্জনতা টা টের পেল আনুভা। এতক্ষন নিজের ভেতরের হাজার টা মানুষের কথা বেজে চলছিল, তার রেশ টা কেমন হঠাৎ করেই কেটে গেছে। অন্য সময় হলে হয়তো অবাক হতো, কিন্তু ইদানিং কোন কিছুতেই আর অবাক লাগেনা। মনে হয় সব স্বাভাবিক।

ঠিক কতদিনের পরিচয় ছিল রুপম এর সাথে, ঠিক কতদিন দেখা হয়েছে, কতটুকু বুঝতে পেরেছে তাকে? তবু কি গাড় অনুভুতি ভালবাসার! আশে পাশের সবকিছুকে তুচ্ছ মনে হয় সে অনুভুতির কাছে। এলোমেলো লাগে, প্রচন্ড এলোমেলো লাগে। কতভাবে কতবার চেষ্টা করেছে রুপম কে খুঁজে পাওয়ার, কিন্তু কিভাবে যেন মিলিয়ে গেল সে। এত এত অভিমান নিয়ে হয়তো তার সামনে দাঁড়িয়ে দুটো কথাও ঠিক মত বলা যেতনা, কিন্তু দাঁড়াতাম তো! হয়তো ওর চোখ দেখে বুঝতে পারতাম, যদি সত্যি ভালবাসত! হয়তো জানতে চাইতাম, কেন এমন হল! অথবা শুধুই তাকিয়ে দেখতাম! শীত পড়তে শুরু করেছে, হালকা কুয়াশা রাতের আলোয় হঠাৎ মনে হল কেমন একটা আবছায়ার মত কেউ যেন দাঁড়িয়ে দূরে। ঠিক এদিকেই তাকিয়ে আছে, ঠিক আমার চোখের দিকে। আর মনে হল আমার চোখে চোখ পরতেই সে ঘুরে চলে গেল। কেমন যেন একটা অনুভুতি হল, মনে হল ওটা যেন রুপম, ঠিক ওরকম ভাবেই যেন হেঁটে গেল সে।

আজ সবকিছুর পরো ভাবছিলাম হয়তো সে আসবে। সে না আসলেও হয়তো একবার ফোন করবে। অথবা একটা ক্ষুদেবার্তা। কিন্তু কিছুই হলোনা।

সকালে ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে প্রথম যে কথাটা মনে হল তা হচ্ছে বাসার দরজার সামনে কেউ ফুল রেখে গেছে। এরকম স্বপ্ন দেখেই ঘুম ভাঙ্গল। বাসায় ফুপি এসেছে। আমার সাথেই ছিল রাতে। ফুপি কে ঘুম ভেঙ্গে বললাম “জানো ফুপি মানুষের মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে মানুষের সাথে এমন সব রসিকতা করে!” ফুপি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বললাম “স্বপ্নে দেখলাম কেউ যেন এসে আমার দরজার সামনে হাজার হাজার ফুল রেখে গেছে!” ফুপি হেসে বলল “আজ তো তোর জন্মদিন, দেখ কেউ কিছু রেখে যেতেও পারে।” ফুপির কথা শুনে যেন মুখ থেকে ঠিক হাসি বের হল না। তার বদলে মনে হল ঠিক আমার উচিত এখান থেকে দূরে কোথাও গিয়ে থাকা। এসব ভাবতেই ভাবতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম দরজার সামনে। আর দরজা খুলে নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। স্বপ্নের সাথে মিল নেই যদিও, তবু অল্প কিছু চন্দ্রমল্লিকা ফুল। হলুদ চন্দ্রমল্লিকা, আর সাথে একটা চিরকুট যাতে লেখা-
“ঠিক যখন তুমি চন্দ্রমল্লিকা গুলো পাবে, একটি বার শুধু একটি বার বারান্দায় এসো”

ফুল গুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসলাম। এত সস্তা রোমান্টিসিজমের সময় বা মানসিকতা কোনটাই নেই আমার। ভাল লাগেনা এসব। ভাল লাগেনা কোও কিছুই , আমার আগের পৃথিবী, আমি সব যেন কেমন বদলে গেছে! ঠিক মত খেতে পারছিনা, কথা বলতে ইচ্ছে হয়না কারোসাথে, আমার অবস্থা দেখে আমার ফ্রেন্ড রাও আমার সাথে এখন আর মিশে না আগের মত। কারো সাথেই আমি আর ভাল ভাবে কথা বলতে পারিনা। মনে হয় সবাই অভিনয় করছে। শুধুই অভিনয়।

বাবা মা আমার চিন্তায় অস্থির। আর এজন্যেই ফুপি কে আনা হয়েছে আমি জানি। কিন্তু আমার ফুপির সাথেও কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। মনে হয় মহিলা এত বোকা কেন, সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে সে এত হাসছে কেন? বাবা একবার বিয়ের কথা তুলেছিল, কিন্তু আমি গোড়াতেই না করে দিয়েছি। বিয়ে! আমার নিজেকে আমি নিজে সামলে নিতে পারছি না, আর বিয়ে করব। ঠিক কিভাবে আশা করা যায় আমার কাছ থেকে যে আমি আবারো কাউকে ভালবাসব? হয়তো বাসব, সময়ের প্রয়োজনে। কিন্তু সেসব বহু পরের কথা।

ফুপি বায়না ধরেছে কাল থেকে শপিং এ যাবে। আমি জানি এটাও একটা বাহানা মাত্র। বলেছি একদিন যাবো। সারাটা দিন ওভাবেই কাটল। নিজের ঘরে, চুপচাপ। মা এসছিল কয়েকবার, দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছে।

সন্ধ্যায় কি মনে করে জানিনা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি দেখলাম, ফুপি বসে আছে। আমায় বলল “এই আনুভা জানিস অনেকক্ষন ধরে খেয়াল করলাম একটা লোক আমাদের বাসার দিকে তাকিয়ে আছে, ওই যে দূরে” ইশারা করার সাথে আমি যেই তাকালাম, ছেলেটা ঘুরে চলে গেল। হঠাৎ মনে হল এই ছেলেটাই কি কাল ছিল? কিন্তু ফুপির দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছিল, তাই ওসব ভাবনা বাদ দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম। আর তারপরি দেখলাম মোবাইল এ মেসেজ-

“ভেবেছিলাম আরো দেরী করবে। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে বুঝলে, সেই সকাল থেকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন কিছু খেতে যাচ্ছি। শুভ জন্মদিন। ”
কেমন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল রক্তে। মনে হল এ কে? রুপম নাতো? এমন করে কথা তো আমার সাথে রুপম ই বলতো। সাথে সাথে মেসেজ এর নাম্বার টায় ফোন করলাম কিন্তু নাম্বার বন্ধ।
জেগে রইলাম সারা রাত। তারপর আরো কিছু রাত। কখনো নিজের সাথে ঝগড়া, কখনো কল্পনার রুপমের সাথে। কখনো মনে হয় ওকে দেখলেই দৌড়ে জড়িয়ে ধরব, আর কখনো মনে হয় গালে ঠাস করে একটা চড় দিব।

এর কিছুদিন পর আবার একদিন রাতে ওই মানুষ টাকে দেখতে পেলাম। এবার আরো একটু কাছে সে। কেন যেন মনে হল ইচ্ছে করেই একটু কাছে এসেছে! আমি বারান্দা থেকে উঠে যেতেই আবার সেই একি নাম্বার থেকে মেসজ
“ যদি জানতে চাইতে, অথবা আমাকে জানাতে দিতে, তবে জানতে কতটা ভালবাসি। ”
ঠিক ওই মুহুর্তের অনুভুতি কোনভাবে বোঝানো যায় না। মনে হচ্ছিল এখন দৌড়ে গিয়ে দেখি কে এই ছেলে?কেন এমন লুকোচুরি। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে আমার আর কতটুকুই বা বাকি আছে! কেন আমার সাথেই এমন হচ্ছে!

তার ঠিক দু দিন পরের ঘটনা। একটা রঙ্গিন কাগজে মুড়ানো বক্স এনে দিয়ে গেল কুরিয়ার থেকে। আমার নামে। মা আমার রুমে দিয়ে গেলেন। খুলে দেখি খুব সুন্দর কাঁচের একটা পুতুল। খুব সুন্দর! সাথে একটা কাগজের খামের ভেতর আমার কিছু ছবি। ছবি গুলো দেখার পর মনের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম। এই ছবি গুলো রুপম তুলেছিল। সাথে আরো একটা চিরকুট। লেখা “অসংখ্য বার ভেবেছি তোমার সামনে মাথা নত করে দাঁড়াবো। অসংখ্য বার ভেবেছি বলব আমি নির্দোষ। কিন্তু তুমি কেন বুঝে নিলেনা? কেন ভুল বুঝলে এই অভিমান কুড়ে খেয়েছে। এরপরো ফিরে এসেছি, অনেক বিশ্বাস আর ভালোবাসা নিয়ে। আমায় ফিরিয়ে দেবে না তো?”

যখন মনে হচ্ছিল পৃথিবীর ঠিক এখানেই শেষ, ঠিক সেখানেই নতুন করে যেন কিছু শুরু হল। তবু একরাশ অভিমান ভর করল আনুভার মনে। মনে হল নির্দোষ! প্রমাণ কি দিতে পারবে? আর যদি আজ বিশ্বাস করি, কাল যে আবার এমন হবে না, তাই কি হয়! জীবনটা তো সহজ সরল হওয়ার কথা ছিল, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! আজ এত অবিশ্বাস নিয়ে কিভাবে ফেরা যায় বলতে পারো রুপম! ফেরা যায় না! আঁধারের দাগ একবার গায়ে লাগলে সে ছায়ার মত সারাক্ষন পেছনে থাকে। আর সে ছায়া থেকে নিস্তার একমাত্র ওই আঁধারে। এর বেশ কিছুদিন পরের কথা। ফুপির বদৌলতে জানতে বাকি নেই রুপম প্রতি রাতে ওই ল্যাম্প পোষ্টের নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু এভাবে লুকোচুরি কেন? সামনে এসে কেন বলতে পারেনা যদি এতই সাহস থাকে। বলবেনা সে, বলতে পারবেনা।

সেদিন ফুপির সাথে শেষ পর্যন্ত শপিং এ বের হলাম। কিছুই কিনিনি, ওসব ইচ্ছে হয় না এখন আর। ফুড কোর্টে বসে ছিলাম আনমনে। ফুপি খাবার এর অর্ডার করতে গিয়েছে। আর তারপরি দেখলাম আমার সামনে রুপম দাঁড়িয়ে। একদম বদলে গেছে, কেমন যেন হয়ে গেছে চেহারা, সেই হাসি নেই, প্রচন্ড বিষন্ন। উশকোখুশকু চুল, আর দাড়ি গোঁফের জঞ্জাল। ওকে দেখে মনে হল আমি এক্ষুনি কেঁদে ফেলব। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম। রুপম চুপ করে তাকিয়ে রইল। নিজেকে যথেষ্ট সংযত করে বললাম, “কেন এসেছ?” রুপম কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল “ফিরে এসেছি। তোমার কাছে।”
ওর চোখে পানি! আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। একটুও না। এতদিন ধরে যে ভালবাসা লালন করে এসেছি নিজের মাঝে আজ সামনে ওকে দেখে সে সব অভিমানে ভরে গেল। বলতে চাইলাম, তোমায় অনেক ভালবাসি, অনেক। ফিরে আসবে কেন তুমি, তুমি তো এখানেই ছিলে। কিন্তু বলতে পারলাম না। বললাম “ যেখানে ছিলে সেখানেই যাও। আমি প্রচন্ড ক্লান্ত। প্রচন্ড।” বলেই আমি চলে এলাম। দাঁড়াতে ইচ্ছে হলোনা। চলে এলাম ওকে পেছনে রেখে।

শুধু সেই মুহুর্ত গুলোর জন্যে কতদিন অপেক্ষা করেছি, আর আজ ওকে ফিরিয়ে দিয়ে এলাম। কি করব আমি, কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক বুঝতে তো পারিনা।
এর কিছুদিন পর ফুপি একটা পেপার এনে ধরল আমার সামনে। যার মাঝে লেখা অহনা তার মামলা তুলে নিয়েছে। স্বীকারোক্তি তে বলেছে, রুপম কে ভালবেসে না পাওয়াতেই সে এসব করেছে। বাকি সব মিথ্যে!

বাকি সব মিথ্যে! সব মিথ্যে!
পাথরের মত হয়ে গেলাম আমি। ফুপি কে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম, জানিনা কতক্ষন। আর আমি সেই রুপম কে ফিরিয়ে দিয়েছি! কিভাবে পারলাম আমি! এত আশা করে যে এসেছিল আমার কাছে, এত কিছুর পরেও, আমার এত খারাপ ব্যাবহারের পরেও যে এসেছিল আমার সামনে তাকে আমি ফিরিয়ে দিয়েছি! অথচ কোথায় পাবো আমি এখন ওকে। কিভাবে বলব ফিরে এসো।


লিখেছেন: Mrinmoyee Hossen

No comments:

Post a Comment