Thursday, October 3, 2013

নৈশব্দে

প্রায় সাড়ে তিন বছর পর আবার সেই রেস্টুরেন্টটায় আসল নুশেরা। অনেক বদলে গিয়েছে সব,টেবিল আরো বেড়েছে,জায়গাও বেড়েছে অনেকখানি। দেয়ালের রংটাও নতুন করা হয়েছে বোধহয়,পুরোটাই নতুনের মত। সেই বৃষ্টির বিকেলের পর আর এখানে আসা হয়নি নুশেরার। কোনের সেই টেবিলটায়ও বসা হয়নি অনেকদিন। এখনো আছে টেবিলটা,শুধু চাদরটা লাল থেকে নীল হয়েছে,চেয়ারদুটোও এখনো মুখোমুখিই। বদলায়নি ম্যানেজারও,বুড়িয়ে গেছেন কিছুটা। এতদিন পরেও ভুল হয়নি তার,নুশেরা ঢুকতেই সেই চেনা হাসি মুখেই জিজ্ঞাসা করে সে,এতদিন পর আসলেন আপা?ভাই আসবে নাকি?



হুম,বলে কোনার টেবিলটার দিকে এগিয়ে যায় নুশেরা। খালিই আছে টেবিলটা,এগুতে এগুতে এতদিন পরে সেই পুরোনো ভালবাসাটা অনুভব করে সে,কত স্পর্শ,কত আবেগ,কত স্বপ্নের বুনন হয়েছে এই টেবিলে বসে। এই টেবিলে বসে কতদিন অপেক্ষা করেছে নিহাল নুশেরার জন্যে। কত বর্ষায় কাকভেজা হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধোঁয়া উঠা গরম কফিতে মুখ ডুবিয়েছে দুজন। সুখস্মৃতিগুলো সত্যিই কত সহজে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। মানুষগুলো এত দ্রুত কিভাবে বদলে যায়। হিসেবের খাতায় রাফ লিখে কত সহজেই কেটে ফেলে,ছুঁড়ে ফেলাটা কতই না সহজ। সব কিছু শেষ হওয়ার পরও কেন যেন আজকে মানা করতে পারেনি নুশেরা,পাক্কা ২বছর ৭মাস তের দিন পর ফোন দিয়েছিল নিহাল। দেখা করতে বললে নুশেরার ক্ষমতা হয়নি সেই আহবান প্রত্যাখান করার,একটা সময় তো এই আহবানটার জন্যে প্রতিটা রাতেই বসে থাকত নুশেরা। গভীর রাতে অপেক্ষা করত সেই পরিচিত কন্ঠে আবেগের কাঁপুনি শুনতে। কত রাত যে পুরনো সেই স্মৃতির অত্যাচার থেকে বাঁচতে ঘুমের ঔষধের উপর নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে নিজেও জানেনা নুশেরা। মাঝে মাঝে যখন অসহ্য লাগত অত্যাচার চলত শরীরের উপর,নিজের ঘরটাকেই তো জগত করে নিয়েছিল ও,বাইরের আলো থেকে গুটিয়েই রেখেছিল। আজ অনেকদিন পর বাসা থেকে বের হল,অনেক দিন পর সেই তুলে রাখা লাল শাড়িটা পড়েছে নুশেরা। অনেক দিন,অনেক অনেক অনেক দিন পর অনুভবে সেই কিশোরীবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে নুশেরার,আগের মত ছেলেটার জন্যে দু:শ্চিতা নিয়ে অপেক্ষা করতে ভাল লাগছে। ওয়েটার ছেলেটা এক কাপ কফি দিয়ে যায় সামনে,হাসে নুশেরা। ম্যানেজারের দিকে তাঁকায় সে,লোকটা এখনো মনে রেখেছে। সবই হয়ত আগের মতই আছে,শুধু আগের স্থানটায় নেই নুশেরা আর নিহাল। উষ্ণতা পেতে চুমুক লাগায় নুশেরা,অতীতের ডায়েরীটার মলাট খুলতে বড় ইচ্ছে হয় ওর। একসাথে পাশাপাশি থাকার সেই দিনগুলো সত্যিই আজ ফিরে পেতে ইচ্ছে করে নুশেরার।


নুশেরা আর নিহালের প্রথম দেখা কোচিং এ,কিশোরী বেলার কোন এক দুপুরে কোচিং শেষে দেখা তাদের্। বোনকে নিতে এসেছিল নিহাল। তারপর প্রায়ই বোনকে নিতে কোচিং এ যেত নিহাল,ক্যাডেটে পড়ত ও। পরীক্ষার বন্ধেই এসেছিল বাসায়। নিহালকে দেখার পর কি হয়েছিল জানেনা নুশেরা,আজও এই অনুভুতির কোন কারণ খুঁজে পায়নি ও। সেই বয়সটাই হয়ত ছিল এরকম। কি যেন ছিল ছেলেটার চোখে ভালবাসা নাকি শুধুই কিশোরীর প্রতি ভাললাগা। কথা বলা বাড়ে দুজনের,ফোনের প্রাপ্যতা তখনও খুবই কম। কথা হত কোচিং এ যেতে আসতে। বেশীদিন থাকতে পারেনি নিহাল। ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল,তবে কি যেন আবেশ দিয়ে গিয়েছিল ছেলেটা নুশেরাকে। অদ্ভুদ কিন্তু অসম্ভব সুন্দর এক ভাল লাগার মোহে পড়ে গিয়েছিল নুশেরা। নভেম্বরের শীতের কোন এক সকালে নিহালের প্রথম ফোন পায় নুশেরা,বাসার ল্যান্ডফোনে। বড্ড পাগলাটে ছিল ছেলেটা,ক্যাডেটের আধাসামরিক জগতটায় থেকেও কিভাবে যেন অনেক খেয়াল রাখত নুশেরার্। আসলেই দিনগুলো ছিল স্বপ্নের মত,প্রতিদিন একেকটা এডভেঞ্চার্। এই খেয়াল রাখা,এই পাগলামীর প্রেমেই হয়ত পড়ে গিয়েছিল নুশেরা,স্কুল পালিয়ে ফোন ফ্যাক্সের দোকানটাই তো ওর আপন লাগত তাই। আর গভীর রাতে শৃঙ্খলার বেড়ি ভেঙ্গে যখন ফোন আসত নিহালের,ফিস ফিস সেই কথা গুলো এখনো স্পষ্ট মনে আছে ওর। স্বপ্নের বুনন চলত ফোনের দুপাশে। কোন কিছুই বোঝার ক্ষমতা তখন ছিলনা নুশেরার,শুধু অপার্থিব এক ভাল লাগা জড়িয়ে রেখেছিল ওকে। তাইত ফোনের ওপাশ থেকে যখন বলত ভালবাসি,নিজেকেও আটকাতে পারেনি নুশেরা। উচ্ছল কিশোরীর ভালবাসার পুরোটা জুড়েই তখন ছিল সেই পাগলাটে ছেলেটা। কিশোরীর ভালবাসায় নাকি এক ভয়ংকর উত্তাপ থাকে,সেই উত্তাপেই হয়ত শৃংখল ভাঙ্গার সাহস পেত নিহাল। ক্যাডেটে তখন চিঠি খুলে দেখা হত,তাইত সাংকেতিক ভালবাসা গুলো শুধু অনুভব করতে পারত দুজন। ঠিক ছয়মাস পর দেখা করে নুশেরা,কিন্তু দেখাটা কেন যেন অনেক বেশী অসাধারন ছিল। একটা অধিকার অনুভব করছিল ও নিহালের উপর,এক ধরনের আমিত্ব ছিল নিহালের উপর। কিশোরীর নারীত্বে এক ধরনের পূর্নতা ছিল স্পষ্ট,হয়ত স্বপ্নীল এক পরিবারও সাজিয়ে ফেলেছিল ও। নুশেরা,নিহাল,নুশেরার বাবু,সব নিয়েই এক আপন জগট বানিয়ে নিয়েছিল ও। সম্পুর্নই নিজের একটা পৃথিবী,নিজের একটা পরিবার্। তারপরের দিনগুলি যে কিভাবে যাচ্ছিল নিজেও জানত না নুশেরা,সুখের সেই সময়গুলো কেন যেন দৌড়ে পালায়। এই টেবিলেই প্রতিদিন হাত ধরে বসে থাকত নিহাল,নিষিদ্ধতা আর লুকোচুরির সেই সময়গুলোতে সবই ছিল স্বপ্নের মত। একদম স্বপ্নের মত,অসম্ভব সুন্দর এক আবেশী স্বপ্ন। যে স্বপ্ন অজান্তেই ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি ফুটায়।


সেবারও বেশীদিন থাকা হয়নি নিহালের। দের মাস পরই আবার ফিরে যেতে হয় সেই বন্দীত্বে। অবশ্য কিছু একটা দিয়ে গিয়েছিল সে নুশেরাকে,এক প্রচন্ড আবেগী ভালবাসা আর অসাধারন কিছু সুখ স্মৃতি। ভালবাসাটা যখন বুঝতে শিখে নুশেরা তখন তার পুরোটা অস্তিত্ব জুড়েই ছিল একজন,নিহাল। কিশোরীর প্রথম ভালবাসায় যে আকুলতা থাকে তা পরিণত প্রেমের পাগলামীতে থাকেনা। এরপর কথা হত,আবেগও বাড়ত,কোন অভিমান অনুযোগ কিছুই ছিলনা নুশেরার। নিখাদ ভালবাসা নিয়ে পৃথিবীটা হঠাত করেই তার কাছে ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগতে শুরু করেছিল। চিরন্তন সত্যটা তখনো জানা ছিলনা নুশেরার্। যে সুখ হঠাত করে আসে তা ক্ষনিকেই হারিয়ে যায়,তাই হয়ত ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যটা ভয়ঙ্কর হতাশায় রুপ নিতে সময় নেয়নি। এইত কয় বছর হবে,বছর দেড়েক পরে যখন নুশেরা হঠাত বুঝতে নুশেরা না বরং নুশেরার বেস্ট ফ্রেন্ড নীরার প্রতিই বেশি আগ্রহ নিহালের,তখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি ওর্। নুশেরার ভালবাসায় এক সরলতা ছিল,যা এই জটিল সমীকরণ গুলোকে কখনো সমাধানের সুযোগই দেয়নি। বাস্তব সংখ্যা আর জটিল সংখ্যার মাঝে মডুলাস আর্গুমেন্ট নিয়ে তাই খেই হারিয়ে ফেলছিল নুশেরা। বিশ্বাস ছিল কিন্তু বিশ্বাসে যখন দাগ পড়ে সেখানে থাকে একরাশ ঘৃণা। ঘৃণাটা কখনোই করতে পারেনি নুশেরা,না নিহাল কে না নীরাকে। আপন মনেই নিজেকে গুটিয়ে ফেলছিল বৃত্তের কেন্দ্রে। পৃথিবীটা এখান থেকেই বিপ্রতীপ হতে শুরু করে ওর কাছে। তারপর যেন পুরোটা জুড়ে থাকা নিহালের জায়গায় এক শুন্যতা অনুভব করতে থাকে নুশেরা। কিশোরীর প্রেমের উত্তাপটা হয়ত ততদিনে নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল নিহালের উপর অথবা তা সক্রিয় ছিল নীরার ক্ষেত্রে। যোগাযোগ কমতে থাকে,আর রাত জাগা বাড়তে থাকে নুশেরার। একসময় ইনসমনিয়া থেকে বাঁচতে বিকল্প পন্থা খুঁজে নেয় নুশেরা। ঘুমের ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় ও যখন বুদ হয়ে রাতের শেষে ঘুমাত তখন হয়ত নিহাল বসে থাকত নীরার হাত ধরে সেই পুরনো টেবিলটায়। এইত কাটছিল সময়,তবে খুব বেশিদিন লাগেনি নিহালের আবার ফিরে আসতে। হঠাত ঝড়ের মত আবারও ফিরে আসে ও নুশেরার হয়ে। সেদিন যখন সরি বলছিল সময় লাগেনি নুশেরার সব ভুলে যেতে। রাত জাগা সময়গুলোর হিসাবটা আর নিহালের কাছে চায়নি ও,চায়নি বিষন্নতার সেই রাতগুলো ফিরে পেতে। ক্যাডেট লাইফ শেষে যখন চারমাসের অবসর তখন নুশেরার কাছে দ্বিতীয়বারের মত পূর্ণতা নিয়ে এসেছিল নিহাল। তখন না ছিল নীরা,না ছিল ব্যাস্ততা। পুরোটা জুড়েই শুধু নুশেরা। তাইত ভাঙ্গা বিশ্বাসটা সহজেই জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিল নুশেরা। ভুলটাকে সেও রাফ ভেবে কেটে দিয়েছিল। কিন্তু হয়ত এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। সেই চারমাসও ছিল পুরোটাই রঙ্গীন। নুশেরার স্কুলের সামনে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকত নিহাল। ছুটির পর চলত এগিয়ে দেওয়ার টালবাহানা। কখনোও বা স্কুল ফাঁকি দিয়ে হাঁটা। সহজেই পুরনোকে ভুলে গিয়েছিল নুশেরা,ভালবাসার সরলতাকে জটিল করতে পারেনি ও। হয়ত চায়নি। জীবনের বাস্তবতার চেয়ে ভালবাসার স্পর্শই বেশী টানত ওর কিশোরী বেলাকে। গল্পটা হয়ত এই সুখের মধ্যেই শেষ হতে পারত,কিন্তু কেন যেন কার চোখ লেগে গিয়েছিল সুখটায়। ক্ষনে ক্ষনে পাল্টে যেত সুখের আবেশটা।


চারমাস শেষে হঠাতই সামরিক বাহিনীর ডাক পায় নিহাল,বেশ উঁচু পদেই। দূরত্বটা আবারো বাড়ে। ব্যস্ততার মিথ্যা অজুহাতে তখন নিহালের কাছে সময় ছিলনা সরল ভালবাসার্। একান্ত নিজের মত করেই ছুঁড়ে ফেলেছিল নিহাল দ্বিতীয়বারের মত। তাইত নুশেরার হাজারো ফোনের শব্দে কাঁপুনি ধরেনি ওর বুকে। সত্যটা অবশ্য শুনতে সময় লাগেনি নুশেরার। বন্ধের চারমাস ভালমত কাটাতে নীরাকে না পেয়েই নাকি নুশেরার কাছে ফিরেছিল নিহাল। পুরোটাই ছিল ওর ইগোকে বাঁচাতে,প্রেম নামক স্ট্যাটাস বজায় রাখতে যেখানে নুশেরার অনুভুতির মূল্য ছিল নিতান্তই মূল্যহীন। এই কথাটা শুনে কোন কিছুই হয়নি সেদিন নুশেরার। ততদিনে ও এতটা ভালবেসে ফেলেছিল যে ঘৃণা করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল। যাকে প্রচন্ড ভালবাসা যায় তাকে কখনো ঘৃণা করা যায়না,শুধুই ভুলে যাওয়ার অভিনয় করা যায় মাত্র। তখনো বিশ্বাস ছিল নুশেরার,হয়ত আসবে নিহাল। কিন্তু সময়টা এতটাই নি:সঙ্গ ছিল যে আর নিজেকে ফিরে পেতে পারেনি নুশেরা। যখন হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে হাসপাতালের সাদা বেডে শুয়ে চোখ ভিজাত ও,তখন এস এস সি কড়া নাড়ছিল দরজায়। নিজেকে মানিয়ে নেয়ার,নিজেকে ঠিক করার সময়টাও ছিলনা ওর হাতে। এতটাই শুন্যতা দিয়ে গিয়েছিল নিহাল,যে তা থেকে পালাবার পথ পায়নি নুশেরা। পুরোটা পুর্ণ করে আবার পরমুহূর্তেই যেন সব কেড়ে নিয়েছিল ও। পরীক্ষাটা যাচ্ছেতাই হতনা,কিন্তু কেন যেন ভাগ্য দেবীও কিছুটা বিমুখ ছিলেন। সম্পুর্ন আলাদা এক স্কুলে সিট পড়ে ওর,একাকীত্বের তীব্রতাটা তখন থেকেই বুঝতে শুরু করে নুশেরা। অনুভব করতে শেখে বাস্তবতায় বাঁচতে হয় নিজের জন্যে,নিজের ভাল থাকার জন্যে। ক্ষনিকের যে ভালবাসা আসে তা ক্ষনিকেই মিলিয়ে যায়,তাই সেই ভালবাসায় হারাবার কিছু থাকেইনা। খুব কম সংখ্যক ভাগ্যবান মানুষ থাকে যারা ভালবাসার মাঝে নিজের ভাল থাকা খুঁজে পায়। আজকাল নুশেরার হিংসা হয় এসব মানুষকে দেখলে,কোন একদিন সেও এতটাই সুখী ছিল হয়ত। কথায় আছে সময় সব ভুলিয়ে দেয়। একসময় সেই বোবা আর্তনাদও চাপা পড়ে গিয়েছিল নুশেরার্। শুধু রাতের নিস্তব্ধতায় চোখের দুই কোনে বর্ষা ঝড়িয়েই ভাল ছিল ও। মাঝে মাঝে ঝাপ দিত ঘুমের ঔষধে,হয়ত জেগে দেখত সাদা বিছানায়। নিহালের দেয়া লাল শাড়ী জড়িয়ে ধরে রাতের পর রাত কাঁদলেও ভালই ছিল নুশেরা। দিন কাটত,কিন্তু রাতটা যেন কাটতই না। মাঝে মাঝে ছুটিতে যখন বাসায় আসত দেখা হত রাস্তায়,তখন নুশেরার চোখের দিকে নিহাল তাঁকাত কিনা কে জানে। ছল ছল করা চোখে স্বপ্নগুলোর হাতছানী আর স্বপ্ন ভঙ্গের বিষাদ দুইটাই থাকত পূর্ণরুপে। আস্তে আস্তে পুরো অস্তিত্বে শুন্যতা নিয়েই ভরে যেতে থাকে নুশেরা,হয়ত পৃথিবীর কাছে পূর্ণ থাকার এক হেয়ালী করত ও। রাতের অন্ধকারের ফুপিয়ে কান্নার শব্দটাতো চারদেয়ালের বাইরের পৃথিবীর কানে যেতনা। ফোলা চোখগুলো ঢাকতে হত চশমার লেন্সের অভিসারী ক্ষমতায়। মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতায় যখন অচেনা নাম্বার থেকে কল আসত নিহালের ফোনে,তখন শুধু দীর্ঘশ্বাসের শব্দই শোনা যেত অপর পাশে। নুশেরার গলা যখন চিনতে পারত নিহাল, প্রত্যুত্তরে ভেসে আসত অসহ্য কিছু শব্দ,ভালবাসার পুরষ্কারই হয়ত ছিল সেই শব্দগুলো। সত্যিই কি ভালবাসা বলে কিছু ছিল দুজনের মাঝে? তাও মেনে নিত নুশেরা,শব্দগুলো যাই হোক নিহালের কন্ঠ শুনতেই বারবার সেই পরিচিত নাম্বারে অপরিচিত হয়ে ফোন দিত ও। কষ্টগুলো সয়ে আসছিল আস্তে আস্তে,হয়ত পরাবাস্তব থেকে বাস্তবতার ব্যবধান বুঝতে সময় লেগেছিল নুশেরার কিন্তু সামলে নিয়েছিল ও। অন্তত চাচ্ছিল সামলে নিতে। পেরেছিল কতটা বা পেরেছে কতটা তার হিসেব নুশেরার চোখের কোনে শুকিয়ে যাওয়া সাদা দাগ গুলো দেখলে হয়ত বোঝা যায়।


এরপর সময় গড়িয়েছে অনেক,নিহাল শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়েছে,আবার ফিরেও এসেছে দু'বছর পর্। ফিরে আসার খবরটা অবশ্য পায়নি নুশেরা,হঠাতই নিহালের ফোন পেয়ে চমকে উঠেছিল ও। পরপর তিনবার বাজার পরও ধরতে পারেনি ও,ভয় হচ্ছিল,হয়তবা আকাঙ্খাও ছিল। আড়াই বছরের দমানো সেই অপেক্ষার শিহরণ গলায় ছিল স্পষ্ট। দেখা করার আকুতি,পুরনো শাড়ি পড়ার অনুরোধ,আবার সেই অধিকার দেখানোটাকে বিশ্বাস হচ্ছিলনা আর নুশেরার্। তবুও গহীনের কোথাও শব্দ পাচ্ছিল প্রশ্রয়ের্। তাইত আজ আবার সেই পুরনো টেবিলটায়,সেই পুরনো সাজে।
-নুশ।
ডাক শুনে চমকে উঠে নুশেরা,ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় এক পলকে। সেই পরিচিত গলা,সেই পরিচিত ডাক। হুম এই নামেই হয়ত নিহাল ডাকত ওকে। স্মৃতিটা সত্যিই মলীন হয়ে গেছে। হয়ত কিশোরী অনুভূতিটা আর নেই আজ,তাইত উচ্ছলতার বদলে এক দীর্ঘশ্বাস পড়ে। চাপা কথার চেয়ে তরুনীর বিশ্বাসটা বড় হয়ে দাঁড়ায়।
-কি বলবে নিহাল?
-আমাকে তো তুমি নিহাল বলে ডাকতে না,পুরনো নামটা কি ভুলে গেলে?
-পুরনো তো আর কিছুই নেই,না তুমি আছ,না আমি আছি। যা বলার বল,বাসায় যাব আমি। দেরী হচ্ছে।
-পুরনোতে কি ফিরে যাওয়া যায়না নুশ??আমার আগের সেই নুশকি আজ এতটাই দূরের?
-এসব কথার কোন মানে হয়না নিহাল। একটা সময় হয়ত এসবে অনেক কিছু আসত যেত,কিন্তু এখন সেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি আমি। ছুঁড়ে ফেলবার অধিকারটা আর দিতে চাইনা তোমাকে। হিসেবের খাতাটা খুলে দেখতে চাইনা আমি,চলে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই,ভাল থেকো।
কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ায় নুশেরা। গলা কাঁপেনি একটিবারও,হয়ত ঘৃণা অথবা হয়ত ভাল থাকার প্রতি আসক্তি। নুশেরা পিছনে তাঁকায়না। ও জানে পিছনে তাঁকালে হয়ত আহবানটাকে প্রত্যাখান করার ক্ষমতা হবেনা ওর্। কিন্তু কিছু আহবান প্রত্যাখান করার জন্যেই। পৃথিবীতে অবিশ্বাসের সুখের চেয়ে নৈশব্দের আর্তনাদটাই ভাল থাকার জন্যে যথেষ্ট। একটা সময় মানুষকে অনেক বেশী স্বার্থপর হতে হয়,নিজের জন্যে। শুধুমাত্র নিজে ভাল থাকার জন্যে। সেই সময়টা এর আগেও একবার এসেছিল,কিন্তু বিশ্বাসটা সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আজ এই কুড়িতে এসে,আবেগের চেয়ে স্বার্থটাই বড় নুশেরার কাছে। জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন কাছে পাওয়ার চেয়ে দূরে ঠেলাই জীবনের জন্যে ভাল। নুশেরার বারবার ইচ্ছে হয় একবার পিছে ফিরে তাঁকাতে,ইচ্ছে হয় নিহাল এসে ওর হাতটা ধরুক,ওর পাশে থাকুক সারাটা জীবনের জন্য। কিন্তু ওর কল্পনার সেই সরল নিহাল যে পরাবাস্তব,বাস্তবের নিহাল কে সেই অধিকার দেওয়ার ইচ্ছেরা সেই কিশোরী বেলাতেই মরে গেছে। আপন জগতে সুখেই আছে নুশেরা,রাতের নৈশব্দে প্রতারনা করে ছুঁড়ে ফেলার মত আর কেও নেই ওর জীবনে। শুন্যতা থাকলেও ভয় নেই বিশ্বাস ভঙ্গের্। বিলটা দিয়ে যখন সেই টেবিলটার দিকে শেষবারের মত তাঁকায় অজান্তেই কোথায় যেন বিষন্নতার বর্ষা শুরু হয়ে যায়। সত্যিই অনুভুতিটা থেকে পালানো অসম্ভব,তবু নিজেকে ভাল রাখতে পালিয়ে বেড়াতে হয় সারাক্ষন। পালিয়ে বেড়ানোর মাঝেই হেয়ালী হয়ে যায় আরো একবার।

No comments:

Post a Comment