Monday, October 7, 2013

বাস্তব ভালবাসা

 

শাহাদত বিশাল এক ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছে।অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার কারনে নিজেকে সবসময় খাম্বা খাম্বা মনে হয় তার।খাম্বা হতে ভাল লাগছে না এখন তার কারন পিচ ঢালা রাস্তায় যে রোদ পড়েছে তাতে খাম্বাবেশী শাহাদত কেন রাস্তার পিচ পর্যন্ত গলে যাচ্ছে।এই রোদকে পিচ গলানো রোদ বলে আর সেখানে শাহাদতের খাম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে ভুলেও আসার কথা না মাথায়।সে ইচ্ছে করলে বাড়িটার ভেতর ঢুকতে পারে অনায়াসে।গেটে দাঁড়ানো দারোয়ান মোটা গোফওয়ালা রমিজ মিয়া তাকে কিছুই বলবে না কারন সে এই বিরাট বাড়ির কেয়ারটেকার।কিন্তু সে যাবে না তার ছোট্ট রুমে।সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে।সে নীচে নামবে আর সে হাসিমুখে বলবে,শাহাদত ভাই একটা রিক্সা ডেকে দেন না ।তারপর হয়তোবা মধুর কিছু বকা দিবে।বকাগুলো শাহাদতের কাছে সবসময় মধুর মনে হয়।শাহাদত এই ডাকটা আর বকাটা শোনার জন্য দেড় ঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে আছে।ভেতরে লিফটের দিকে সে বার বার তাকাচ্ছে। নাহ লিফট তো আট তলায় যাচ্ছে না।বড্ড অস্থির লাগছে শাহাদতের তবে কি আজ নুহা যাবে না ভার্সিটিতে?ঐ যে নামছে লিফট এটা নিশ্চয়ই নুহা।শাহাদত রিক্সার দিকে হাক দিল,

-এই খালি আফারে নিয়া যাও।

-কই আফা আর কই নিয়া যামু?অবাক হয়ে রিক্সাওয়ালা বলে শাহাদতকে।

-আরে আসতাছে তারপর যেখানে যাইতে বলবে সেখানে যাইবা।

নুহা নামের পৃথিবীর সবথেকে রূপবতী মেয়েটা ততক্ষনে নিচে নেমে আসে।শাহাদত মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে সবুজ ড্রেস পড়া সবুজ পরীকে।আজ মনে হয় নুহা অনেক রাগ আর মন খারাপ করে আছে।মনে হয় সেই সুন্দর ড্রেস পড়া ভাইজানের সাথে ঝগড়া হইছে কে জানে।শাহাদত হাসিমুখে সামনে গিয়ে বলে,

-নুহা আফামনি আফনের রিক্সা।সেই কহন থেইক্যা আটকাইয়া রাখছি যাইতে চাইছিল যাইতে দেয় নাই আফনের লাইগ্যা।

-শাহাদত ভাই আপনাকে না কতবার বলছি এভাবে কথা বলবেন না।এভাবে কথা বললে বিশ্রী শোনা যায় বুঝেন না আর এত কথা বলেন কেন আপনি?

এই বলে নুহা রিক্সায় ঊঠে বসল।হঠ্যাৎ কি মনে করে রিক্সা থামিয়ে বলল,

-শাহাদত ভাই একটু শুনুন তো।

শাহাদত আবার তার বিখ্যাত হাসি নিয়ে এগিয়ে গেল নুহার দিকে।

-জ্বী নুহা আপা।

-আচ্ছা আপনি কি বলতে পারেন আমাদের বাসার দরজার সামনে লাল গোলাপের তোড়া প্রতিদিন কে দিয়ে যায়?

-জ্বী না আফামনি।মাথা চুলকাতে চুলকাতে শাহাদত বলে।

-তাহলে কি জানেন বলেন তো?কে আসে যায় কিছুই তো বলতে পারেন না।আপনাকে আমার রিক্সা ঠিক করার জন্য রেখেছে নাকি?যত্তোসব, এই মামা যাও।এই বলে নূহা রিক্সাওয়ালাকে যেতে বলল।

আজ সকাল থেকেই নুহার দিনটা খারাপ যাচ্ছে।সকাল বেলা ঘুম থেকে ঊঠে পেপার আনতে গিয়ে প্রতিদিনকার মত গোলাপের তোড়া আর একটা ছোট্ট কাগজে 'শুভ সকাল' লেখা পায় সে।তার জন্য তার মন খারাপ করার কথা নয়।সকালে সাব্বিরকে কথাটা বলতে এক কথায় দু কথায় অনেক বড় ঝগড়ার সৃষ্টি হয়।সাব্বিরের ভাষ্যমতে নুহার অন্য কারোর সাথে রিলেশন আছে তাই এভাবে ফুল পায় সে।পাক্কা দুই ঘন্টা ঝগড়ার ফলে আজো ক্লাসে যেতে লেট হচ্ছে তার।তাই সকালে শাহাদত নামের লোকটার সুন্দর হাসি দেখে কেন জানি সহ্য হল না।মানুষ এত সুখে থাকে কি করে?তাই দেখে নুহার অনেক হিংসা হয় মাঝে মাঝে।লোকটাকে এত বকা দেই তবু সেই বিখ্যাত হাসি মুখে লেগে থাকে।কিভাবে পারে একদিন জিজ্ঞেস করবে বলে সে ঠিক করে।দেখো আজ সাব্বিরের সাথে তার ঝগড়া লেগেছে কই কিভাবে মিটমাট করা যায় তা না ভেবে সে ভাবছে শাহাদতের কথা।নিজের চিন্তা দেখে নুহা আসলেই অবাক হয়ে যায়।সারাদিন ক্লাসের কারনে সাব্বির অথবা শাহাদত কারো কথাই মনে আসল না তার।ফেরার পথে বলা নেই কওয়া নেই ঝুম বৃষ্টি পড়া শুরু হল।বৃষ্টি দেখলে সাব্বিরের কথা মনে পড়ে তার খুব।কারন এমন বৃষ্টির দিনে সাব্বির তাকে প্রপোজ করেছিল সবার সামনে।সাব্বিরের কথা ভাবতে ভাবতে মোবাইলের স্ক্রিনে সাব্বিরের নামটাও ভেসে উঠল।বাবুর বুঝি রাগ কমল আমার মত পুরোন দিনের কথা মনে করে, এই কথা ভেবে হাসিমুখে ফোন ধরল নুহা।

-হ্যালো তুমি কই?ক্লাস শেষ?

-হ্যা এইতো বাসার সামনে।ক্লাস শেষ করেই আসলাম বৃষ্টির মাঝে।

-ভাল নুহা তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।

-হ্যা বল।

-নুহা আসলে আমি আর পারছি না।

-মানে?

-আসলে সোজাসুজি বলাই ভাল।নুহা আমি আর রিলেশনটা কন্টিনিঊ করতে চাচ্ছি না।

-মানে সাব্বির?তুমি এইগুলা কি বলছ?সাব্বিরের কথাগুলো কেন জানি ঝাপসা শোনাচ্ছিল নুহার।

-আমি যা বলেছি তা তুমি ভাল করেই বুঝতে পেরেছ।দয়া করে আমাকে ফোন দিও না ভাল থেকো।


ওপাশের ফোন কেটে দেওয়ার শব্দ শুনতে পেয়েও নুহা কানের কাছে ফোন ধরে রাখল।নিজের ভেতর অন্যরকম কষ্ট তাকে জড় পদার্থ বানিয়ে ফেলল।নিজেকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছে এক মুহুর্তে।

-আফা নামবেন না?আইসা পড়ছি তো।

রিক্সাওয়ালার ডাকে নিজেকে বাস্তবের মাঝে ফিরে পায়।চোখের সকল বাঁধা ভেঙ্গে কান্না আসতে থাকে তার।কোনমতে রিক্সাওয়ালাকে টাকাটা দিয়ে ঝুম বৃষ্টির মাঝে নেমে পড়ে সে।আকাশের দিকে তাকিয়ে কখন যে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করেছে তা সে নিজেও জানে না।রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে ঝুম বৃষ্টির মাঝে চিৎকার দিয়ে কাঁদছে তা দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে রিক্সাওয়ালাটা।সেই বৃষ্টিভেজা মেয়েটার কান্না দেখে আরো কেউ একজন বৃষ্টিতে ভিজে কাঁদছে সেই কথাটা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ দেখতে পেল না।


নুহা সেদিনের পর থেকে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল।অবাক ব্যাপার হলেও সত্য সেদিনের পর থেকে লাল গোলাপের তোড়াও আসা বন্ধ হয়ে গেল কেন জানি।গত চারদিন যাবৎ কোন লাল গোলাপের তোড়া আসল না ।অবশ্য নুহা কেন জানি সেই গোলাপকেই তার রিলেশন ভাঙ্গার আসল কারন হিসেবে দেখছিল। সকালে আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করল নুহা গত চারদিন যাবৎ শাহাদত নামের হাসোজ্জ্ব্যল লোকটাকে দেখে নি গেটের সামনে রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে।লোকটার কিছু হল নাতো।একবার তার রুমে যাওয়ার কথাটা বারবার মনের মাঝে কেন যেন আসতে লাগল।তাই সে রমিজ মিয়াকে নিয়ে শাহাদতের রুমে গেল।আগে কখনো সে শাহাদতের রুমে আসে নি।ভেতরে গিয়ে ছোট্ট সুন্দর সাজানো গোছানো একটা রুম।রুমটা এতটাই গোছানো দেখে মনে হয় কোন মেয়ে গুছিয়ে রেখেছে।সুন্দর ছোট্ট রুমটার মাঝে শাহাদত নামের লোকটি কাঁথা মুড়ি দিয়ে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকে চলেছে।নুহা কপালে হাত দিয়ে দেখল অনেক জ্বর।লোকটা দেখল সেই জ্বর নিয়ে ঘুমোচ্ছে আর মাঝে মাঝে কি যেন বলছে।একবার ভাবল ডাক দেই।আবার কি ভেবে যেন ডাক দিল না নুহা।সে বরং রুমটা দেখতে থাকল।পড়ার টেবিলের উপর রবার্ট ফ্রোষ্টের একটা কবিতার বই দেখে খুব অবাক হল।শাহাদত নামের সেই ব্যাক্তি কিনা রবার্ট ফ্রোষ্টের ইংরেজী কবিতার বই পড়ে।আসলেই অবাক করা ব্যাপার।বইয়ের কিছু পাতা ঊল্টে দেখতে গিয়ে কিছু গোলাপের পাপড়ি আর একটা চিঠি তার পায়ের কাছে পড়ল।চিঠিটা আবার বইয়ের ভাঁজে রাখতে গিয়ে উপরের নামটা সে খুব অবাক হল।



প্রিয় নুহা,

প্রতিদিন লাল গোলাপের সাথে শুভ সকাল ছাড়া আর কিছু লেখার মত সাহস আমার নেই।বাস্তবতা আমাকে এতটাই ভীতু করেছে যে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে লাল গোলাপের তোড়া দেবার সাহস টুকু হারিয়ে ফেলেছি।কঠিন বাস্তবতা আসলেই বড় কঠিন।এই বাস্তবতার জন্য জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি।হারিয়েছি বাবাকে হারিয়েছি অনেক ছোট ছোট গড়া স্বপ্নকে হয়তোবা হারিয়ে ফেলেছি তোমার মত রাজকন্যাকে।তোমাকে যখন দেখি মনের অজান্তেই নিজের থেকে বেশি ভালবেসে ফেলি।ক্ষনিকের জন্য ভুলে যাই আমার বাস্তবতাকে।যে বাস্তবতা আমাকে ইংরেজীতে ডিগ্রি পাওয়া স্বত্তেও কেয়ারটেকার হিসেবে নিয়ে এসেছে আর এই বাস্তবতাই আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে তোমার থেকে।আমি বিশ্বাস করি মানুষের ভালবাসা নানারকম হয়।আমার ভালবাসাটাও সেই নানারকমের মাঝে একটা।আমি জানি আমি তোমাকে পাব না।পারব না সকলের সামনে লাল গোলাপের তোড়া আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি নুহা।এই সকল কিছু জেনেও আমি তোমাকে ভালবাসি।স্বপ্নে অথবা সকাল বেলায় লুকিয়ে গোলাপের তোড়া দেখে তোমার হাসিটা দেখে অথবা রিক্সা উঠার সময় মিষ্টি কিছু বকা শুনে।এই ভালবাসা নিয়ে আমি অনেক সুখী একজন মানুষ।এর বেশি কিছু চাওয়া আমার মত নগন্য মানুষের পক্ষে সম্ভব না।মাঝে মাঝে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে।তখন চিঠিতে লিখে নিজের মনের ইচ্ছেটা পূরন করি।চিঠিগুলো হয়তোবা তোমার কাছে যাবে না এই ভেবেই লিখি।সবশেষে একটা কথাই বলি বারবার অনেক ভালবাসি তোমাকে অনেক।

ইতি

শাহাদত

-অন্যের পারসোনাল চিঠি এভাবে পড়া উচিত নয় মিস নুহা।শাহাদত বলে ঊঠে

-একবারো বলতে পারলেন না আগে।কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠে নুহা।

বাস্তবতা বলতে দেয় নি।অন্য দিকে তাকিয়ে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করে শাহাদত।


-এখন বাস্তবতাই চাইছে আপনাকে যেন ভালবাসি।

-না তা সম্ভব না।

-কেন সম্ভব নয়।ভালবাসা তো কোন কিছু মেনে দেখে হয় না।ভালবাসা হয় শুধু মন দেখে।যে মনে একজন আরেকজনের প্রতি শুধু ভালবাসা আর বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে,ভালবাসার বাস্তবতা এটাই।

শাহাদত আর চোখের জল আটকে রাখতে পারে না।তার স্বপ্ন যে এভাবে সত্যি হবে তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেই বা জানত।কাঁদতে কাঁদতে সে বলে উঠে,নুহা আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি অনেক।

By Raufun Noor Ratul

No comments:

Post a Comment