রুবাই বাদাম চিবুচ্ছে। ঘনঘন এবং খুব দ্রুত। চোখের পলক পড়ার আগেই বাদাম ঠোঙ্গা থেকে বের হচ্ছে,খোসামুক্ত হচ্ছে তারপর মুখে চালান হয়ে যাচ্ছে। হাত,মুখ, এবং চোখ- কোনটাই বিশ্রাম পাচ্ছেনা এক মূহুর্ত। লম্বা সরু আঙ্গুলগুলো বাদামের খোসা ছাড়াতে ব্যস্ত, মুখ ব্যস্ত তা চিবোতে। আর চোখজোড়া ক্ষণে ক্ষণে আরও লাল হচ্ছে,আরো লাল হচ্ছে। এটা রুবাইর রাগের বহিঃপ্রকাশ। তার ঢাউস হ্যান্ডব্যাগে অন্যান্য জরুরী জিনিসপত্রের সাথে এক ঠোঙ্গা বাদাম থাকবেই সবসময়। কারণ, রাগ হলে বাদাম চিবুনো চাই ই তার। নইলে অন্য কারো মাথা বাদামের খোসার মত ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্য কারো বলতে যার উপর তার রাগ হয় ,তার।
আজ রুবাইর রাগটা একটু বেশী। বাদামবিদ্যা খুব একটা কাজ দিচ্ছেনা। তাই বাদাম চিবুনোর পাশাপাশি,রক্তচক্ষুর প্রদর্শন চলছে। তবে যাকে ঘিরে এত কান্ড,তার এসবের প্রতি অদৌ কোন খেয়াল আছে বলে মনে হলোনা। বেচারা উদাস ভঙ্গীতে আকাশ দেখছে। আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। বাতাস বইছে। হয়ত সে সব মিলিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে,বৃষ্টি হবে কিনা! মাঝে মাঝে বাতাসের গন্ধ নিচ্ছে। বৃষ্টির আগমূহুর্তের বাতাসে নাকি একটা ভেজা গন্ধ থাকে। অথচ এদিকে তার পাশে যে এগারো নং মহা বিপদ সংকেত চলছে,তা বোধহয় সে আমনে নেয়নিঁ।রুবাই গলা খাঁকারি দিল। তপু চোখ নামিয়ে তাকাল সে শব্দে। নীরিহ গলায় জানতে চাইল, "বাদাম শেষ?" রুবাই আরো ক্ষেপে গেল। দৃষ্টিতে নীরব হুমকি, "খায়ালামু!" তপু তা অগ্রাহ্য করে চশমার কাঁচ মুছতে লাগল। "আগামী পরশু বিকাল পাঁচটায়। সিদ্ধান্ত যা নেয়ার,সেদিন নিব।" তপু চশমাটা চোখে লাগিয়ে,রুবাইর দিকে ফিরল। খুশী খুশী গলায় জানতে চাইল, "কোথায়?" যেন তার তর সইছেনা। রুবাই দাঁতে দাঁত পিষল। তপুর মগজ খোসামুক্ত করার অদম্য ইচ্ছেটাকে অনেক কষ্টে দমন করল সে। "পরশুদিন সকালেই জানাব।" খুশীতে দাঁত বেরিয়ে এল তপুর। বাধ্য ছেলের মত মাথা কাত করে বলল, "আচ্ছা।" "তোর দাঁত কেলানো যদি না বের করছি!" রুবাই মনে মনে হুমকি দেয়।
দু'দিন পর। রুবাই রেস্টুরেন্টের গ্লাস ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল। দরজা বরাবয় বেশ কিছুদূরের একটা টেবিলে তপু বসে আছে। রুবাইর দিকে চোখ পড়তেই হাসল। হাত নেড়ে ডাকল কাছে। রুবাই ভ্রু কুঁচকে হাতের সেলফোন দেখল। পঁাঁচটা বাজতে এখনও আট মিনিট বাকি। "ব্যাটা বদমাশ দেখি,আজ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এসে বসে আছে! অথচ দেরী করে আসা নিয়ে এতদিন কত ঝগড়া হত!" সে বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে গেল।
"আজ এত তাড়াতাড়ি ক্যামনে আসছ?" "এত জরুরীভাবে আসতে বলছ তুমি, না এসে উপায় আছে?" "গত চার বছরের মত আজ রাস্তায় গিট্টু জ্যাম ছিলনা? পুলিশ মামার ঠেঙ্গানি ছিলনা? বাইকের চাকা বসে যাওয়া?" তপু হেসে মাথা দোলালো। "নাতো! সবাই বোধহয় বুঝে গেছে,আজ জরুরী কাজ আছে।" রুবাই হ্যান্ডব্যাগ কোলে নিয়ে বসল।তার মেজাজ থমথমে হয়ে আছে। তপুর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল, "আজ কত তারিখ?" "৪ঠা অক্টোবর। আমাদের রিলেশনের চার বছর পূর্ণ হল আজ।" চশমা ঠিক করতে করতে তপুর ঝটপট উত্তর। রুবাই আগের চেয়ে বড় ধাক্কা খেল এবার। অবাকের পরিমাণ আরও বেশী। তপু তারিখ,দিবস সব মনে রেখেছে! অথচ গত কয়েকবার এ দিবসে রুবাইকে একাধিক ঠোঙ্গা বাদাম চিবোতে হয়েছে। কেন যেন তপু দিবসটা বেমালুম ভুলে যেত। আর আজ কিনা....
এ সময় হঠাৎ তপুর সেলফোনটা বেজে ওঠায়,রুবাইর ভাবনায় ছেদ পড়ে।
"হ্যালো,কে? তূর্ণি?.... কাকে খুশী খুশী লাগছে? আমাকে?.... লাগবেইতো! আজ আমি মুক্ত হচ্ছি... আমার জন্য একদম ঠিক তোমার মত একটা মেয়ে দেখো... আরে না! রুবাই কিছু বলবে কেন? আজ আমাদের ব্রেকআপ হচ্ছেনা?..... এইতো ,ও আমার সামনেই বসে আছেত।........ এনিভার্সারী তো কী হয়েছে? রিলেশন এনিভার্সারী আজ থেকে ব্রেকআপ এনিভার্সারী হবে...... হাহাহা..........আজ সন্ধ্যায় লং ড্রাইভে যাবে?...."
রুবাই আর সহ্য করতে পারলনা। টেবিল থেকে কাঁটাচামচ তুলে খোঁচা দেওয়ার ভঙ্গীতে তপুর চোখের কাছে ধরল। "ফোন কাট বলছি। কাট কাট।" তপু থতমত খেয়ে কল কেটে দিল। তার হাসি উধাও এখন। বিব্রত বোধ করছে বেচারা। "তুই তোকারি করছ কেন?" "আমার ইচ্ছা। একটা কথাও বলবিনা খবরদার। নইলে আন্ধা কইরা দিমু। তূর্ণির সাথে লং ড্রাইভ! কথা বলতে নিষেধ করছিলাম না ওর সাথে?" তপু চুপ করে রইল। ভয়ে না রাগে,তা বোঝা গেল না। রুবাই কাঁটাচামচটা তপুর চোখের আরও কাছে নিয়ে গেল। "জবাব দিচ্ছিস না যে?" "তুমিইতো বললে কথা না বলতে!" তপু মিনমিন করে প্রতিবাদ জানায়। রুবাইকে আরো ক্ষেপে উঠতে দেখে, বেচারা আত্মসমর্পণের ভঙ্গীতে হাত তোলে। "বলছি.....আসলে তূর্ণির সাথে গতকাল রাহার বাসায় দেখা। তখন...." রুবাইর চোখজোড়া আকারে দ্বিগুণ হয়ে গেল। যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে। "রা..রাহার বাসা মানে? তুই রাহার বাসায় ও যাস?" "আমার দোষ নেই। মুন্নী ফোন করে বলল জরুরী দরকার।" "মুন্নীইইই!!! ও তোর নতুন নাম্বার পেল কোথায়?" রুবাই প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে। ততক্ষণে তার কোলে রাখা হ্যান্ডব্যাগ টেবিলের উপর উঠে এসেছে। আর অবসর হাতটা তা হাতড়ে বেড়াচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে তপু বুঝল, রুবাইর রাগ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে। সে এখন বাদাম চিবুবে। "না মানে....সাজেদা বাসায় এসেছিল ঐদিন। তখন আমার ফোন থেকে.........তোমার বাদাম লাগবে? ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার করি?"
ঠিক সেই মূহুর্তে রুবাইর হাত বাদামের ঠোঙ্গার খোঁজ পেল। ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলের উপর দিয়ে ঠেলে দিল। একদম তপুর সামনে। তপু হাসিমুখে বলল, "ছুলে দিতে হবে?"
রুবাই শান্ত ভঙ্গীতে কাঁটাচামচ হাত বদল করল। "না। খোসাসহ খাওয়া হবে আজ।"
পরিশিষ্টঃ সেদিন তপু-রুবাইর ব্রেকআপটা হতে গিয়েও হয়নি। এমনকি পরবর্তী এক সপ্তাহয় ও না। কারণ,ঐ এক সপ্তাহর বেশীরভাগ সময় বেচারা তপুকে টয়লেটে কাটাতে হয়েছে। বন্ধুবান্ধব সবাই জানে, সে এনিভার্সারীর দিন বেশী খেয়ে ফেলেছিল। তাই এ অবস্থা। সঠিক ঘটনা জানে শুধু রুবাই এবং তপু। আর এখন থেকে জানবেন আপনারা। আসলে সেদিন চোখ বাঁচাতে গিয়ে, তপু বেচারাকে এক ঠোঙ্গা বাদাম খেতে হয়েছিল। তাও খোসাসুদ্ধ!
No comments:
Post a Comment