Tuesday, October 8, 2013

সেই মুখ


শাফায়াত হাতের ঘড়িটা দেখল। কাঁটাটা ঝাপসা; তবে সময়টা আন্দাজ সাড়ে সাতটা হবে। চশমা পরার প্রয়োজন মনে করলো না। তার কাছে রুগীই আসেনা যে রুগী দেখার জন্য চশমা পরতে হবে। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে হাতের কাছের সুইচ বন্ধ করে দিল। ঘরের সিএফএল লাইটটা বন্ধ হয়ে গেল; কিন্তু ডিম লাইটটা ঘোলা লাল একটা আভা তৈরী করল। এই আলো-আঁধারী পরিবেশ যে শাফায়াতের খুব প্রিয় তা না। তার ভাল লাগে ঘুটঘুটে অন্ধকার; কারন সেই অন্ধকারে কেউ তাকে দেখতে পায়না। এই ফালতু রোম্যান্টিক আবছা টিমটিমে আলো দিয়ে রাখা লাগে জাহিদের জন্য। জাহিদ ক্লিনিকের বয়ের কাজ করে; কোন পেশেন্টের ল্যাব টেস্টের রেজাল্টের দরকার হলে শাফায়াতের কাছে আসে। এই সামান্য কাজটা করতে গিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কয়েকবার জাহিদ উষ্টা খেয়েছে; সেই থেকে টিমটিমে আলোর ব্যাবস্থা।



ক্লান্তি খুব বেশি না শাফায়াতের; অবসাদটা বরং তাকে ঝিমিয়ে রেখেছে। চোখ বন্ধ করে চাবাগানে জ্যোৎস্নার কথা ভাবতে লাগল। সেই ফোর্থ ইয়ারে পড়বার সময় গিয়েছিল; তাও প্রায় এক যুগ আগে। এরপরে আর সিলেটে যাওয়া হয়নি। ক্লিনিক থেকে প্রতিবছরই ট্যুরে যায়। শাফায়াত কূপের মন্ডুক; ওসব অনুষ্ঠান ওর কাছে অসহ্য লাগে। জ্যোৎস্নার কল্পনায় বাধা আসলো; কঁচকঁচ করে দরজা খুলে জাহিদ এক রুগীর আসার খবর দিল। শাফায়াত হাতের কাছের সুইচটা অন করে রুগীকে পাঠাতে বলল।

দরজা দিয়ে ছোট্ট একটা মেয়ে ঢুকল; দশ-বার বছর বয়স হবে। ফর্সা, হ্যাংলা, রুগ্ন একটা চেহারা। এই বাচ্চাকে শাফায়াত আগে কখনও দেখেনি; কিন্তু মারাত্নক চমকে গেল সে। মেয়েটা দেখতে হুবুহু নদীর মত দেখতে। সেই উৎসুক চাহনী, হাসি হাসি চেহারা, চওড়া ঠোঁটটা যে খুব দৃষ্টিনন্দনতা না। কিন্তু কিভাবে যেন মানিয়ে গেছে। এই কিভাবে যেন মানিয়ে যাবার ব্যাপারটা শাফায়াতের কাছে খুব চেনা আর পুরানো। মেয়েটা আস্তে আস্তে হেঁটে টেবিলের সামনের চেয়ারে এসে বসে; মুখে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে খুক খুক করে কাশি দেয়। শাফায়াত আবার চমকায়; এই কাশি দেবার ভঙ্গীটাও নদীর মত। শাফায়াত চট করে চোখ নামিয়ে নেয়। মেয়েটার মুখ দেখা মানা তা না; রুগীর চেহারা দেখা দোষের কিছু না; কিন্তু এই বাচ্চা মেয়েটা অযথা শাফায়াতের বুকের বাঁপাশে চিনচিনে ব্যাথার একটা অনুভূতি তৈরী করছে। চোখ নামিয়ে নিয়ে বাম দিকে ঘুরে গ্লাসের কভার সরিয়ে ঢক ঢক করে আধা গ্লাস পানি খেয়ে নেয়; পানির সাথে মুখের ভেতর সারট্রালিনের একটা ট্যাবলেট চালান করে দেয়। স্টেডি থাকা দরকার। যেই চেহারা শাফায়াত ষোল বছর ধরে এড়িয়ে আসছে; আজ এক বাচ্চার মুখে সেই অবয়ব ফিরে এসেছে। এই সামান্য পিচ্চিটার উপস্থিতি তাকে অস্থির করেনি; অস্থির করছে এই চেহারা যেটা তার জন্য একরাশ কষ্টের স্মৃতির বাহক।

মাথা নীচু রেখেই শাফায়াত মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করে। আবারও একটু খুক খুক করে কেশে একটা প্রেসক্রিপশান এগিয়ে দেয় মেয়েটা; কাশির কারনে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে তার। প্রেসক্রিপশান হাতে নিয়ে নাম, বয়স, ঠিকানা এইসব নতুন করে তার ডেস্কের প্যাডে লিখতে থাকে। সাথে কেউ এসেছে কিনা জানতে চায়; বলতেই বলতেই রঙচঙে একটা বোরখা ঘরে ঢুকল। মুখ নীচু করে রাখার কারনে মহিলার মুখ দেখতে পায়না। বাচ্চা মেয়েটা মহিলাকে মা বলে সম্বোধন করে। লেখা শেষ করে শাফায়াত মুখ তুলে তাকায়। দ্বিতীয় চমকের পর সে বুঝতে পারে পিচ্চির চেহারা তার কাছে এত পরিচিত মনে হচ্ছিল কেন। শাফায়াত আর নদী ষোল বছর পর পরস্পরকে দেখতে পেল। সন্দেহে, বিস্ময়ে একজন আরেকজনকে দেখতে থাকে। ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য নিরবতা নেমে আসে।
শাফায়াতই প্রথমে অচেনার ভান করে চোখ নামিয়ে নেয়। বুকের ব্যাথাটা কমেনি বরং বেড়েছে। ড্রয়ার খুলে বিটা ব্লকার খুঁজতে থাকে; না পেয়ে চেয়ারটাকে ঠেলে পেছনের দিকে নিয়ে যায়। মোচড় দিয়ে মাল্টিপারপাস চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে ছোট্ট একটা আলমারীতে অষুধটা খুঁজে বের করে। প্যালপিটিশান হচ্ছে, হাত-পা কাঁপছে, বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা অবাধ্যের মত লাফাচ্ছে, গলার কাছে অদৃশ্য কিছু একটা আটকে গেছে, বারকয়েক ঢোক গিলেও সুবিধা হয়না। অনেক পরিচিত এই কষ্টের অনুভূতিগুলো অনেকদিন পরে শাফায়াতের কাছে প্রকটভাবে ফিরে এসেছে। নদীর সাথে সম্পর্কের সময় তার এমন হত। সবসময় হত না; যখনই নদীর সাথে ঝগড়া হত তখনই এমন হত। কিন্তু এখন কেন হবে? নদীর সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ষোলবছর আগেই; নদীই তাকে ছেড়ে চলে গেছিল। শুধু ছোট্ট একটা ফোনকল করেই নদী তার সমস্ত দায় ছেড়ে চলে গেছিল। আর ফিরে আসেনি। এরপর চব্বিশ ঘন্টার জন্য শাফায়াতের সঙ্গী হয় এই গলা শুকানো, অবাধ্য হৃদপিন্ডের লাফালাফি, হাত-পা কাঁপা, প্যালপিটিশন। আজ হারিয়ে যাওয়া নদীর ফিরে আসার সাথে সাথে অনুভূতিগুলাও ফিরে এসেছে। কয়েকরকম ট্যাবলেট খেয়ে নিজেকে কিছুটা স্থির রাখার চেষ্টা করে চেয়ার ঘুরিয়ে টেবিলের কাছে আসে। অন্য কোন রুগী হলে ডাক্তারের এই আচরনে অবাক হত; কিন্তু নদীর কথা আলাদা। সেও এই সন্ধ্যাটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এতগুলো বছরেও শাফায়াতের চেহারা এতটুকুও বদলায়নি; নদীর অবাক হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

নিজেকে ঠিক রেখে নদীকে না চেনার ভান করে পিচ্চি মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করতে শুরু করে। নদী নিজেই তার মেয়ের সমস্যাগুলা বলতে থাকে। কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে। কয়েকবার ঢোক গিলে দু’একবার সযত্নে চোখ মুছে মেয়ের সমস্যা খুলে বলে। শাফায়াত সব দেখেও না দেখার ভান করে। টেস্টের জন্য মহুয়াকে কাগজ হাতে জাহিদের সাথে পাঠিয়ে দেয়। এক্সরে রিপোর্ট পেতে আধাঘন্টা মত সময় লাগে; সেই সময়টুকু নদী আর মহুয়াকে ক্লিনিকেই বসে থাকতে হবে। ঘর থেকে বের হয়ে যেতে লাগলে শাফায়াত নদীকে উদ্দেশ্য করে ঘরেই থাকতে বলে। ক্লিনিকের বসার জায়গাগুলা ভাল না, তার উপরে মহুয়া মাঝেমধ্যেই কাশছে; তাই ঘরের মধ্যেই দু’জনকে বসতে বলে শাফায়াত। কিন্তু ভুলেও পরিচয়ের কথা বলেনা; একজন ডাক্তার হিসেবেই ঘরে বসতে বলে। নদী বা মহুয়ার জন্যে আলাদা খাতির দেখাচ্ছে না সে, সব রুগীর সাথেই সে এমন করে। তার রুগীরা সবই শিশু; তাই বাইরের নোংরা বসার জায়গায় রুগী বা রুগীর লোকদের বসতে না দিয়ে ঘরেই বসতে দেয়। রুটিন নিয়ম বলেই এমনটা করে; নাহলে নদীকে চোখের সামনে বসতে দিতে শাফায়াতের ইচ্ছা কখনই হবেনা। অকাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে শাফায়াত; নদীকে কোনভাবেই কথা বলতে দিতে চায়না সে।

নদী মাথা নীচু করে পাথর হয়ে বসে থাকে। পুরানো স্মৃতিগুলা মাথায় ঘুরতে থাকে। আজ অনেকদিন পরে এভাবে শাফায়াতকে দেখতে পাবে, এটা ভাবেইনি নদী। কলেজ ছাড়ার পর আর শাফায়াতকে দেখেনি ও। কী মনে করে শাফায়াতকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে ওঠে।
- তুমি তাহলে পেডিয়াট্রিশিয়ান?
- হুম... (নদীর দিকে না তাকিয়েই গোমড়া মুখে উত্তর দেয় শাফায়াত)
- ভাল আছ?
- হুম...
- আমাকে চিনতে পেরেছ?
- হুম...
- তুমি ঢাকাতেই থাক?
- হুম...
- বিয়ে করেছ? (বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে নদী)
- তাতে আপনার কি কিছু আসে যায়?
নদী শাফায়াতের এই উত্তরে চমকে যায়। শাফায়াত তাকে আপনি করে বলেছে। তার চেয়ে বড় কথা, এই এক কথাতেই শাফায়াত তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে অনেকদিন থেকেই নদী আর শাফায়াতের কেউ হয় না। শাফায়াতের কিছু জানার অধিকার সে বহু আগেই হারিয়েছে; সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিল শাফায়াত, ছোট্ট একটা প্রশ্নে।
মহুয়া ফিরে আসে এক্সরে রুম থেকে। এই অল্প পরিশ্রমেই খুব ক্লান্ত সে; মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
এমন সময় নতুন আরেক রুগী আসে; সেই রুগীর সাথে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে শাফায়াত। না চাইতেও সেদিকে তাকিয়ে থাকে নদী। অজান্তেই আবার চোখ ভিজে আসে নদীর। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিজের চোখ আলতোভাবে মুছে নেয়।
প্রেসক্রিপশান নিয়ে রুগী চলে গেলে নদী আবার কথা বলে ওঠে। শাফায়াত যাই ভাবুক; নিজের মনকে আর প্রবোধ দিতে পারেনা নদী। কেন যেন জানতে ইচ্ছা হয় শাফায়াত সুখে আছে কিনা; অপ্রয়োজনীয় হলেও শাফায়াতের ভাল থাকাটা যে নদীর জন্য খুবই জরুরী।
- বললা না বিয়ে করেছ কিনা?
- না, করিনি... (মুখ খিঁচিয়ে অপ্রিয় সত্যটা বলে শাফায়াত)
- কেন?
- সেটা তুমি জান। (রাগ কমে আসায় সে “আপনি” থেকে “তুমি”তে)
- তুমি তাহলে সত্যিই তোমার কথা রেখেছ? (শাফায়াত বলেছিল সে নদীর অপেক্ষায় থাকবে; মৃত্যু পর্যন্ত। সে নাকি নদী ছাড়া অন্য কোন মেয়েকে মেনে নিতেই পারবে না। শাফায়াতকে ছেড়ে আসার পরে নদী এই কথাটা ভুলেই গেছিল। এখন শাফায়াত যখন বলল “সেটা তুমি জান” তখন নদীর মনে পড়ল শাফায়াতের দেয়া সেই ছোট্ট ওয়াদাটার কথা। নদী প্রচন্ড অবাক হয়।)
- আমি যখন যা বলি, সেটাকে সত্যি জেনেই বলি।
- তাই বলে এভাবে তুমি আমাকে অপরাধী করবে? (কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে নদী। বিবাহিতা সে, এক মেয়ের মা; কিন্তু শাফায়াতের সাথে হঠাৎ এই সাক্ষাৎ তার তরুনী মনটাকে চুপ থাকতে দিচ্ছেনা।)
- আমি কিভাবে তোমাকে অপরাধী করলাম? আমি কি তোমার বাসার সামনে গিয়ে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে রেখেছি? তোমাকে কোনভাবেই জানতে দিয়েছি আমার কথা?
- না, তুমি সেটা করনি। এমন তুমি করবে না এটাও জানি।
কঁচকঁচ করে দরজাটা খুলে যায়; জাহিদ এক্সরে রিপোর্ট নিয়ে এসেছে। রিপোর্ট দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে শেষ করে আবার জাহিদের হাতে দিয়ে দেয়। জাহিদ কাগজটা নদীর হাতে দেয়। ঝাপসা চোখে শাফায়াতের হাতের লেখাটা পড়তে শুরু করে। নিউমোনিয়া হয়েছে মহুয়ার। কাগজটা জাহিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মহুয়াকে তার সাথে নীচতলায় ডিসপেন্সারিতে পাঠায়। নিজেও বেরোবার জন্য উঠে দাঁড়ায় নদী; আজ শরীরটা বড় ভার লাগে তার কাছে।
ভেজা গলায় একটা আকুতি জানায় শাফায়াতের কাছে,
- আমি আসি। আর... প্লিজ, এইভাবে আমাকে গিল্টি কোরোনা। একটা বিয়ে কোরো। আমি জানি, আমার চেয়েও অনেক ভাল মেয়ে তুমি পাবা। আমি খুব খারাপ, আমি তোমাকে কখনই সুখী করতে পারতাম না। তোমাকে সুখী করতে পারবে এমন ভাল একটা মেয়েকে বিয়ে কোরো।
- আমি ভালোই আছি। আমার ভাল নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। শহরে অনেক পেডিয়াট্রিশিয়ান আছে; এরপর থেকে আর কোনদিন আমার সামনে আসবে না। আর আসলেও আমার কাছ থেকে কোনও ভাল আচরন পাবার আশা করবে না। আমি তোমাকে ভুলে গেছি। আর আমি বিয়ে করবো কি করবো না, সেটা আমার ব্যাপার। এখনো করিনি নিজের দেয়া ওয়াদার কারনে, তোমার কারনে না। সো তোমার গিল্টি ফীল করার কোনই কারন নাই। এখন বিদায় হও। (খুব শক্তভাবে কথাগুলো বলে শাফায়াত)
নদী বেরিয়ে যায়। দরজার কাছে গিয়ে একবার পিছনে তাকানোর কথা মনে হয় তার। অযথা মায়া বাড়বে বলে চাওয়াটাকে গুরুত্ব দেয়না। করুন চাহনী দিয়ে নদীর চলে যাবার পথে তাকিয়ে থাকে শাফায়াত।
শাফায়াতের অপরাধবোধ হয়। অনেকদিন পর আজ সে একটা মিথ্যা বলেছে। নদীর কারনেই সে বিয়ে করেনি। নদীর জায়গাটায় ষোল বছর ধরে চেষ্টা করেও অন্য কাউকে বসাতে পারেনি শাফায়াত; কখনও পারবেও না।

**********************************************
গল্পের শাফায়াতেরা হয়তো সত্যিই বিয়ে না করে নিজের ওয়াদা পূরনে সংকল্পবদ্ধ থাকে। কিন্তু নদীর মত মেয়েরা ষোল বছর পরে শাফায়াতকে চিনতে পারলেও কথা বলেনা। তাদের আবেগগুলো গোল্ডফিশ মাছের স্মৃতির মত ক্ষণস্থায়ী; আর তাদের ইগো হিমালয়ের মত বিশাল। সেই হিমালয় টপকে আবেগেরা বাইরে আসতে পারেনা।

By- নাদান নিপুণ 

1 comment:

  1. “অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মত এমন বিড়ম্বনা আর নাই।”

    ReplyDelete